বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা ইউনিয়নের কালুপাড়া গ্রামের সন্তোষ কর্মকারের ছেলে কলেজ ছাত্র শুভ কর্মকার মহামারী করোনা রোগীর চিকিৎসা সেবায় এবার দ্বিতীয় রোবট উদ্ভাবন করেছেন। নতুন উদ্ভাবিত এই রোবটের নাম ‘সেবক’। চিকিৎসাসেবায় কাজ করবে বলে এর নাম সেবক রাখা হয়েছে বলে জানান শুভ কর্মকার। চিকিৎসা ক্ষেত্রে সরাসরি সহযোগিতার জন্যই তার এই প্রচেষ্টা। দুই ভাই বোনের মধ্যে বড় শুভ। তিনি সরকারী গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক শেষ করে ভর্তি হয়েছেন বরিশাল অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়ে। কিন্তু তার আফসোস, কলেজে ভর্তির পর একদিনও ক্লাশ করতে যেতে পারেননি। মহামারি করোনা সংক্রমণ রোধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় তার এই প্রতিবন্ধকতা। সেই সুবাদে নিজের রোবট নিয়ে কাজ করার বিস্তর সুযোগ হয়েছে। শুভ কর্মকার বলেন, ভবিষ্যতে আমি শুধু রোবট নিয়েই কাজ করতে চাই। রোবটিক্স আমার প্রিয় বিষয়। রোবট উদ্ভাবন করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করতে চাই। ডাক্তার যত দূরেই থাকুক না কেন নির্দেশনা মেনে রোগীর সুচিকিৎসা নিশ্চিত করবে এই রোবট।
এবার এমনই একটি রোবট উদ্ভাবন করেছেন একাদশ শ্রেণির ছাত্র শুভ কর্মকার। তার রোবট শুধু চিকিৎসা সেবায় অবদান রাখবে না, পাশাপাশি রোগীর অক্সিজেন সেচুরেশন কমে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন করে ১৫ থেকে ২০ মিনিট অক্সিজেন সরবরাহ করতে পারবে। একই সঙ্গে ঔষধ আনা-নেওয়া, অক্সিজেন মাস্ক পরিয়ে দেওয়া, রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধ সরবরাহ করা, সংক্রমিত রোগীর বর্জ্য তার শরীরে থাকা ইউভি রশ্মির মাধ্যমে জীবানুমুক্ত করতে পারবে। এর আগে ২০১৮ সালে জগদ্বিখ্যাত রোবট সোফিয়া যখন বাংলাদেশ ভ্রমণে আসে তখন তাকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শুভ কর্মকার প্রথম উদ্ভাবন করেন রোবট ‘রবিন’। ২০১৭ সালের অক্টোবরে সৌদি আরবে নাগরিকত্ব পাওয়া রোবট সোফিয়া শুধুমাত্র ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেও ওই সময়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শুভ কর্মকারের উদ্ভাবিত ‘রবিন’ বাংলায় কথা বলতে পারতো এবং যে কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো। ফলে ‘রবিন’ দৃষ্টি আকর্ষণ করে পুরো দেশবাসীর। শুভ কর্মকার বলেন, রবিন মানবাকৃতির রোবট। কোথাও আগুন লাগলে বা গ্যাস লিকেজ হলে সংকেত পাঠাতে পারতো। কিন্তু দেশসহ সারাবিশ্ব করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের সঙ্গে লড়াই করছে।
এ ক্ষেত্রে আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি এমন প্রশ্ন থেকেই দ্বিতীয় রোবট ‘সেবক’ উদ্ভাবনে হাত দেই। তিন মাসের প্রচেষ্টায় একটি মডেল বাস্তবায়ন করেছি। তিনি আরও বলেন, এমনভাবে একটি রোবট তৈরি করা হলে সে প্রকৃত পক্ষেই ডাক্তার এবং রোগীর মধ্যে যোগাযোগের একটি মাধ্যম হয়ে কাজ করতে পারবে। ‘সেবক’ সরাসরি রোগীর কাছে যেতে পারবে। তার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে সঙ্গহীন রোগীকে সঙ্গ দিতে পারবে। ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাক্তার বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক রোগীর সর্বশেষ অবস্থা সরাসরি দেখতে পারবেন, রোগীর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন এবং প্রেসক্রিপশন দিতে পারবেন। শুভ কর্মকার বলেন, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে ভিডিও কলে ডাক্তার এবং রোগী কথা বলতে পারেন। কিন্তু করোনায় সংক্রমিত রোগীর কাছে কেউ সহসাই যেতে চান না। এক্ষেত্রে কার্যকরি ভূমিকা রাখবে রোবট সেবক। কারণ কোনো রোগীর অক্সিজেন সংকট দেখা দিলে রোগীকে অক্সিজেন সরবারহ করতে পারবে। এছাড়াও রোগীর বর্জ্য রোবট সেবকের শরীরে থাকা ডাস্টবিনে ফেলা হলে ইউভি রশ্মির মাধ্যমে তা জীবানুমুক্ত করে ফেলবে। সেক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি নেই। রোবট ‘সেবক’ বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন করা হলে করোনা মোকাবেলা সহজ হবে। রোগী তার প্রয়োজনীয় সেবা পাবে আবার চিকিৎসকও নিরাপদ দূরত্বে থেকে চিকিৎসা দিতে পারবেন।
শুভ আরও বলেন, আমার প্রথম উদ্ভাবিত রোবট রবিনের প্রযুক্তি আরও আধুনিক ও উন্নত করতে কাজ করছি। কারন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে বিশ্বের অনেক দেশ রোবটিক্স ওয়ার্কে অনেক এগিয়ে গেছে। রোবট হয়ে উঠেছে উত্তম বন্ধু। কিন্তু বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। আমি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশ যেন রোবট বা কম্পিউটার প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকতে পারে সেজন্য কাজ করছি। আমি মানব কল্যাণে রোবট উদ্ভাবন করতে চাই। ২০১৮ সালের ১৫ মে জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রের উদ্ভাবন বিষয়ক জাতীয় পর্যায়ে দ্বিতীয় হয়ে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের কাছ থেকে পুরস্কার লাভ করে রবিনের উদ্ভাবক শুভ কর্মকার। ২০১৯ সালের ২৭ জুন ৪০তম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের হাত থেকে পুরস্কার নেয়। এছাড়াও সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ-২০১৯ এ বিজ্ঞান বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে ১ম হয়ে জাতীয় পর্যায়ে অংশ নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির হাত থেকে ‘বছরের সেরা মেধাবী’ পুরস্কার নেয় শুভ কর্মকার। তারই ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় রোবট উদ্ভাবন করলেন এই ক্ষুদে বিজ্ঞানী। সরকারী গৈলা মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ জহিরুল হক জানান, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র শুভ কর্মকার ২০১৮ সালে প্রথম উদ্ভাবন করে বাংলা ও ইংরেজিতে কথা বলা রোবট রবিন। এখন শুনলাম শুভ কর্মকার আরও একটি রোবট করোনা রোগীর চিকিৎসায় তৈরি করেছে রোবট সেবক। তিনি বলেন, আমরা ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার ওপর বেশি গুরুত্ব আরোপ করি। যে কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারছে। স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখছে।
তার উদ্ভাবন ও এগিয়ে যাওয়ায় আমরা গর্বিত। রোবট সাধারণত একটি ইলেক্ট্রো-যান্ত্রিক ব্যবস্থা, যার কাজকর্ম, অবয়ব ও চলাফেরা। রোবট বিভিন্ন কাজে মূলত মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। রোবট শব্দটির উৎপত্তি চেক শব্দ ‘রোবোটা’ থেকে, যার অর্থ ফোরসড লেবার বা মানুষের দাসত্ব কিংবা একঘেয়মি খাটুনি বা পরিশ্রম করতে পারে এমন যন্ত্র। রোবট হলো কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত একটি স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা, যা মানুষ যেভাবে কাজ করে ঠিক সেই ভাবেই কাজ করতে পারে অথবা এর কাজের ধরন দেখে মনে হবে এর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আছে। রোবটের বহুমাত্রিক সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব। সহজ ভাষায় বলা যায়, যে যন্ত্র নিজে নিজে মানুষের কাজে সাহায্য করে এবং নানাবিধ কাজে মানুষের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাই রোবট। রোবট প্রাকৃতিক নয়, কৃত্রিম পরিবেশ অনুভব করার ক্ষমতা আছে। পরিবেশের বস্তু নিয়ে কাজ করতে পারে। কিছুটা বুদ্ধিমত্তা আছে, যার সাহায্যে পরিবেশ বুঝে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রোগ্রামযোগ্য। ঘুরতে পারে ও স্থানান্তর করতে পারে। দক্ষভাবে সুনিয়ন্ত্রিত চলন প্রদর্শন করতে পারে। স্বেচ্ছায় কাজ করছে, এরকম আভাসও দিতে পারে এই রোবট।
এ বিষয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আবুল হাশেম বলেন, শুভ কর্মকারের করোনা রোগীর চিকিৎসায় আবিস্কৃত রোবটিকে আরও আধুনিকভাবে তৈরি করার লক্ষে সে চাইলে যে কোন সহযোগিতা করা হবে।
#চলনবিলের আলো / আপন