মুসলমানের স্বভাব-চরিত্রের গঠন যথাযথ হয় যখন তা কোরআন ও হাদিসের আলো লাভ করে। এ শিক্ষা সম্পর্কে মুসলিমরা যত বেশি সজাগ ও সচেতন হবে, তাদের জন্য স্বভাব-চরিত্রের বিশুদ্ধতা অর্জন করা তত বেশি সহজ হবে। তবে মুসলমানের জন্য শুধু ইসলামী শিক্ষা সম্পর্কে অবগত হওয়া যথেষ্ট নয়; বরং তা জীবনে বাস্তবায়ন করাই বেশি প্রয়োজন। ইসলামী শিক্ষা বাস্তবায়নে সবচেয়ে কৃতিত্বের দাবিদার তাঁরা, যাঁরা নিজ জীবনে তা বাস্তবায়ন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এ ক্ষেত্রে রাসুলুল্লাহ (সা.) সবচেয়ে অগ্রগামী। ইহকালে আল্লাহর দাসত্ব এবং পরকালে মুক্তি লাভে শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনচরিত্র কিয়ামত পর্যন্ত আগত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা এবং তা ইসলামী শিক্ষার সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাঁকে শুধু সংক্ষিপ্ত সময় দ্বিন প্রচারের জন্য পাঠাননি; বরং তিনি ২৩ বছর মানুষের মধ্যে ছিলেন, মানুষকে আল্লাহর বিধি-বিধান শিখিয়েছেন, নিজের জীবনে তিনি তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন এবং নিজের জীবনকেই সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত বানিয়েছেন।
নবুয়তের ২৩ বছরে মহানবী (সা.) আল্লাহর একত্ববাদ, আল্লাহর ওপর আস্থা-বিশ্বাস, তাঁর ইবাদত-বন্দেগি, মানুষের কল্যাণ কামনা, সহমর্মিতা, সত্যপক্ষের সাহায্য, ধৈর্য, যুদ্ধ ও শান্তিসহ মানবজীবনের বিভিন্ন অবস্থায় মুমিনের কর্মপন্থা কেমন হওয়া উচিত, তা বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। ফলে সাহাবিদের এমন দল তৈরি হয়েছে, যাঁরা নববী শিক্ষাকে শুধু জীবনে ধারণ করেননি; বরং অন্যদের জন্য নিজেদের জীবনকে দৃষ্টান্ত বানিয়েছেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মুসলিম সমাজে এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করা হয়েছে। সত্য বলতে, ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই পূর্ববর্তীরা পরবর্তীদের জন্য দৃষ্টান্ত হয়েছেন। তখন থেকেই মুসলমানের ঈমান ও আমলের সংরক্ষণে এক প্রজন্ম পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়েছেন। আমরা বই-পুস্তকে নামাজ শেখার আগে অগ্রজদের নামাজ দেখেই তা শিখেছি। অন্যান্য ইবাদতের ক্ষেত্রে এটাই হয়েছে। আমাদের চারিত্রিক ও নৈতিক বিষয়গুলোও অনুরূপ। মূলত পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেই আমরা ভালো ও মন্দ কাজের অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকি। এ জন্য প্রথমে পরিবেশ ভালো করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবেশ ভালো ও পুণ্যময় হলে সেখানে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোও ভালো হয়। আর পরিবেশ যদি বিকৃত ও অরুচিকর হয়, তবে সেখানে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোও বিকৃত রুচি নিয়ে বেড়ে ওঠে।
পরিবেশের উন্নতির জন্য শুধু শিক্ষাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য আরো কিছু প্রয়োজন। প্রথমে নিজের স্বভাব-চরিত্র ভালো করে ‘ভালো দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করতে হবে। এরপর তা গ্রহণের জন্য যত পথ ও পদ্ধতি আছে তা গ্রহণ করা উচিত। হাদিসের নির্দেশ হলো, যে কোনো অন্যায় দেখল সে যেন হাত দিয়ে তা পরিবর্তন করে। তাতে সক্ষম না হলে মুখ দিয়ে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করে। যদি তাতেও সক্ষম না হয় তবে মনে মনে তা পরিবর্তনের চিন্তা করে। এটাই দুর্বলতম ঈমান (পরিচায়ক)। যেমন—মন্দ কাজ হতে যে দেখল সে বাবা হলে হাতে বাধা দিতে পারবে। কিন্তু সে সহকর্মী বা বন্ধু হলে মুখে সাবধান করতে পারবে। আর সে ছোট বা দুর্বল হলে এবং কথা বলার অবকাশ না থাকলে সে মন্দ কাজের প্রতি লক্ষ রাখবে। যখন তার সক্ষমতা বাড়বে সে তা প্রতিহত করবে।
হাদিসে বর্ণিত এ কর্মনীতি যখন কোনো সমাজে বাস্তবায়িত হবে, তা নিঃসন্দেহে পরিবর্তিত হবে। পরিবেশ ভালো হলে, তাতে বসবাসকারীরা ভালো গুণাবলি ও বৈশিষ্ট্যগুলো আপন করে নেবে এবং একসময় পুরো পরিবেশ বদলে যাবে। মুসলিম ইতিহাসে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। আজ পৃথিবীতে সত্য-সততা ও মনুষ্যত্ব বিলুপ্তপ্রায় হওয়ার পরও পৃথিবীর নানা প্রান্তে মুসলমানদের আদর্শ পরিবেশ গঠনের দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায়। উত্তম পরিবেশের দৃষ্টান্ত পাওয়া না গেলেও উত্তম চরিত্র ও নৈতিকতার অধিকারী ব্যক্তির দেখা মিলবে। যারা সংক্ষিপ্ত পরিসরে নিজেকে দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
যারা ইসলামের সুমহান নৈতিকতা ও মূল্যবোধ নানা জায়গায় বাস্তবায়ন করেছেন মূলত তাঁদের মাধ্যমেই সমাজে পুনর্জাগরণ হয়েছে। এ কারণেই যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্ম নিজেদের মৌলিক সৌন্দর্য ও দৃষ্টান্ত হারিয়ে ফেলেছে, সেখানে ইসলাম আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল। মনে রাখতে হবে, ইসলামের মৌলিক সুষমা অক্ষুণ্ন থাকার পেছনে কোরআনি শিক্ষার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এরপর হাদিসের দিকনির্দেশনার অবদান। কোরআন ও হাদিস সব সময় মুসলমানের অভিমুখ ঠিক করে দিয়েছে, জাগরণের প্রেরণা জুগিয়েছে এবং সত্যের পথ দেখিয়েছে। হিদায়াতের উৎস কোরআন ও হাদিসে কোনো পরিবর্তন হয়নি, তবু তার শিক্ষা যতক্ষণ ব্যক্তিজীবনে বাস্তবায়িত না হবে এবং তার অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হবে, তার কল্যাণ পুরোপুরি লাভ করা যাবে না। সুতরাং ইসলামী শিক্ষা নিজ জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তবেই তা মুসলিম সমাজে বাস্তবায়িত হবে। আর যদি আমাদের জীবনে তা বাস্তবায়নে ত্রুটি থেকে যায়, তবে তার সামগ্রিক বাস্তবায়নে অপূর্ণতা থেকে যাবে।
চরিত্র গঠন বা নিজেকে বদলে ফেলা সহজ নয়। যখন মানুষ কোনো কাজে অভ্যস্ত হয়, মানুষের চিন্তা-চেতনা কোনো কিছুর সঙ্গে মিশে যায় তখন তা পরিহার করা কঠিন। তবে মানুষ চাইলে তা অসম্ভব নয়। কেননা পৃথিবীতে আল্লাহর ইচ্ছা ও শক্তির পর মানুষের ইচ্ছাশক্তিই সবচেয়ে কার্যকর। সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.) বলেন, পৃথিবীতে জাগতিক বিচারে আল্লাহর ইচ্ছা ও শক্তির পর সবচেয়ে কার্যকর শক্তি মানুষের ইচ্ছাশক্তি। মানুষের ইচ্ছাশক্তি শুধু ব্যক্তি, সমাজ ও জাতিকে বদলে দেয় না; বরং (আল্লাহর অনুগ্রহে) তা মানুষের ভাগ্য পর্যন্ত বদলে দিতে পারে। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ কোনো সম্প্রদায়ের অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ অবস্থা নিজে পরিবর্তন করে।’ (সুরা : রাদ, আয়াত : ১১)
তামিরে হায়াত থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর