অনলাইন ডেস্ক:রাতের শেষাংশ অত্যন্ত বরকতময় একটি সময়। রাতের নামাজ বা তাহাজ্জুদের নামাজ আল্লাহ তাআলার কাছে একটি প্রিয় ইবাদত। তাহাজ্জুদের নামাজের অনেক ফজিলত আছে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের গুণাবলিতে রাত্রি জাগরণ করার কথাও বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তাঁরা রবের উদ্দেশে সিজদারত ও দাঁড়িয়ে রাত্রি যাপন করে।’ (সুরা : ফুরকান, আয়াত : ৬৪)
রাতের নামাজ শ্রেষ্ঠতম নামাজ এবং জান্নাতে যাওয়ার অন্যতম মাধ্যম। এই সময় আল্লাহ তাআলা পৃথিবীর আকাশে নেমে আসেন। তাই বান্দাদের তাঁর কাছে চাইতে বলেন। রাসুল (সা.) সাহাবিদের তাহাজ্জুদের নামাজের প্রতি উৎসাহ দিতেন। অনেক সময় তিনি রাতে ঘুরে ঘুরে তাঁদের আমল পর্যবেক্ষণ করতেন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমাদের রব প্রতি রাতে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন। রাতের এক-তৃতীয়াংশ থাকা পর্যন্ত তিনি থাকেন। আল্লাহ বলেন, কে আমাকে ডাকবে? আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে চাইবে? আমি তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু দেব। কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে? আমি তাকে ক্ষমা করব।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৯৪)
সাহাবায়ে কেরাম ছিলেন পৃথিবীতে নবীদের পর শ্রেষ্ঠ মানুষ। তাঁদের ইবাদত ও আমল সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা সমস্ত বান্দার অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখেন রাসুল (সা.)-এর পর সাহাবিদের অন্তর সবার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। অতঃপর তাঁদের রাসুল (সা.)-এর সঙ্গী হিসেবে কবুল করেন।’ (আত তাবসিরাহ : ১/৪৭৭)
হিরাক্লিয়াসের বাহিনী মুসলমানদের কাছে পরাজিত হলে তাদের জিজ্ঞেস করা হলো, তোমাদের পরাজয়ের কারণ কী? তখন তাদের এক নেতা বলল, কারণ তারা রাতে (তাহাজ্জুদের) নামাজ পড়ে আর দিনে রোজা রাখে। (ইবনে আসাকির : ১/১৪৩)
সাহাবায়ে কেরাম রাতের ইবাদতকে খুব গুরুত্ব দিতেন। তাঁদের কেউ সারা রাত জেগে নামাজ পড়তেন। কেউ অর্ধরাত জেগে ইবাদত করতেন। কেউ রাতের এক-তৃতীয়াংশ।
আবু বকর (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, এক রাতে রাসুল (সা.) বেরিয়ে আবু বকর (রা.)-কে নিঃশব্দে কিরাত পড়তে দেখলেন। অতঃপর ওমর (রা.)-এর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে সশব্দে কিরাত পড়তে দেখলেন। অতঃপর তাঁরা উভয়ে রাসুল (সা.)-এর কাছে একত্র হলে রাসুল (সা.) বলেন, হে আবু বকর! আমি তোমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, তুমি নিঃশব্দে কিরাত পড়ছিলে। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি তাঁকেই শোনাচ্ছিলাম, যাঁর সঙ্গে চুপিসারে কথা বলছিলাম। অতঃপর তিনি ওমর (রা.)-কে বলেন, আমি তোমার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, তুমি সশব্দে কিরাত পড়ছিলে। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি ঘুমন্ত ব্যক্তিকে জাগাতে এবং শয়তান তাড়াতে চেয়েছিলাম। হাসান বসরি (রহ.)-এর বর্ণনায় রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, হে আবু বকর! তোমার কিরাত একটু শব্দ করে পড়বে এবং ওমরকে বলেন, তোমার কিরাত একটু নিচু স্বরে পড়বে। (আবু দাউদ, হাদিস : ১৩২৯)
ওমর (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : আব্বাস (রা.) বলেন, আমি ওমর (রা.)-এর প্রতিবেশী ছিলাম। তিনি সারা রাত নামাজ পড়তেন, আর দিনে রোজা রাখতেন এবং জনগণের কাজ করতেন। (হিলয়াতুল আওলিয়া-৫৪)
জায়েদ ইবনে আসলাম থেকে বর্ণিত, ওমর (রা.) সারা রাত নামাজ পড়তেন আর রাতের শেষাংশে পরিবারের লোকজনকে নামাজের জন্য জাগিয়ে দিতেন। আর তিনি এই আয়াত পড়তেন, ‘তুমি তোমার পরিবারকে নামাজের আদেশ দাও এবং তাঁর ওপর ধৈর্য ধারণ করো; আমি তোমার থেকে কোনো রিজিক চাই না; বরং আমিই তোমাকে রিজিক দেব।’ (মুয়াত্তা মালেক)
ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ওমর (রা.) এশার নামাজ পড়ার পর নিজ ঘরে সারা রাত নামাজ পড়তেন।
উসমান (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : ইবনে সিরিন (রহ.) বলেন, উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের দিন তাঁর এক স্ত্রী বলল, তোমরা এমন ব্যক্তিকে হত্যা করেছ, যিনি এক রাকাতে পুরো কোরআন খতম করে তাঁর রাত কাটাতেন। (আজ-জুহুদ : ১২৭)
আবু হুরায়রা (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : আবু হুরায়রা (রা.) বেশি নামাজ গুজার ও রোজাদার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সব সময় তাঁর পরিবারে কেউ না কেউ নামাজে থাকত। আবু উসমান নাহদি বলেন, একবার আমি আবু হুরায়রা (রা.)-এর ঘরে মেহমান হই। তিনি, তাঁর স্ত্রী ও সেবক মিলে রাতের অংশকে তিন ভাগে ভাগ করে নেন। পর্যায়ক্রমে তারা সারা রাত নামাজ পড়েন। (আল ইসাবাহ, ৪/২০৯)
ইবনে মাসউদ (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : ওমর (রা.) বলেন এক রাতে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে আবু বকর (রা.) ও আমি হাঁটছিলাম। দেখলাম ইবনে মাসউদ (রা.) মসজিদে নামাজ পড়ছে। তখন রাসুল (সা.) তাঁর কেরাত শুনে বলেন, কোরআন যেমন সবুজ-সতেজ অবতীর্ণ হয়েছে, কেউ যদি তেমনি কোরআন পাঠ করে আনন্দিত হতে চায়, তাহলে সে যেন ইবনে উম্মে আব্দের (ইবনে মাসউদ) মতো কোরআন পাঠ করে। (সহিহ ইবনে খুজায়মা : ২/১৮৬)
আবদুল্লাহ ইবনে ওমরের রাত্রি জাগরণ : রাসুল (সা.) তাঁর সম্পর্কে বলেন, আব্দুল্লাহ কতই না ভালো মানুষ যদি সে রাতে তাহাজ্জুদ পড়ত। এর পর থেকে তিনি রাতে খুব কম ঘুমাতেন। প্রতি রাতে ঘুম থেকে উঠে ফজর পর্যন্ত তিনি তাহাজ্জুদ পড়তেন। নাফে বলেন, যদি কখনো ইবনে ওমরের এশার নামাজ ছুটে যেত, তাহলে তিনি সারা রাত নামাজ পড়ে কাটিয়ে দিতেন। (আল-ইসাবাহ : ২/৩৪৯)
আনাস (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : আনাস (রা.) দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার দরুন তাঁর পা ফুলে যেত। আবার তিনি পুরো রাতকে তিন ভাগে ভাগ করে নেন। প্রথমাংশে তিনি নিজে নামাজ পড়তেন। এরপর তাঁর স্ত্রীকে জাগিয়ে দিতেন দ্বিতীয়াংশে নামাজ পড়ার জন্য। তারপর তাঁর স্ত্রী মেয়েকে জাগিয়ে দিতেন শেষাংশে নামাজ পড়ার জন্য।
তামিম দারি (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : তামিম দারি (রা.) তাহাজ্জুদের নামাজের প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন। তিনি এক আয়াত দিয়ে পুরো রাত কাটিয়ে দিয়েছেন। (আল-ইসাবাহ, ১/১৮৪)
তিনি শুধু নামাজ পড়ার হুল্লা (ইউনিফর্ম জাতীয় বিশেষ কাপড়) কেনেন। আবাদুল্লাহ ইবনে মুবারক বলেন, তামিম দারির ইবাদত সম্পর্কে আমার কাছে যে পরিমাণ হাদিস বা খবর পৌঁছেছে অন্য কারো সম্পর্কে তা পৌঁছেনি। (আজ-জুুহুদ, পৃষ্ঠা ১৯৯)
হাসান-হুসাইন (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : হাসান (রা.) রাতের শুরুর ভাগে তাহাজ্জুদ পড়তেন আর হুসাইন (রা.) রাতের শেষ ভাগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়তেন। গঠনগত ও চারিত্রিক গুণে তাঁরা উভয়ে রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল। (আজ-জুহুদ, ১৭১)
শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.)-এর রাত্রি জাগরণ : শাদ্দাদ ইবনে আউস (রা.) ছিলেন একজন জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তাঁর সম্পর্কে উবাদা ইবনে সামেত (রা.) বলেন, তিনি যখন বিছানায় যেতেন তখন অস্থিরতায় গড়াগড়ি করতেন। আর বলতেন, হে আল্লাহ জাহান্নামের আগুন তো আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। এরপর তিনি দাঁড়িয়ে সকাল পর্যন্ত নামাজ পড়তেন। (হিলয়াতুল আউলিয়া : ১/২৬৪)