হিন্দু সমাজে রয়েছে চারটি বর্ণ। যারমধ্যে শূদ্র একটি। শূদ্র শব্দটি হিন্দু ধর্মের আদি গ্রন্থ ঋগ্বেদে আবির্ভূত হয় এবং এটি অন্যান্য হিন্দু গ্রন্থে যেমন-মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতি, অর্থশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্রে পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের মতো শূদ্র বর্ণেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়। স্বপন চক্রবর্তী নামের এক পুরোহিত বলছেন, “সাহা, ধীবর, মোদক, দাশ, তরণী দাশ, হরিদাশসহ কিন্নরও শূদ্র বর্ণের অন্তর্ভুক্ত একটি সম্প্রদায়।”
শাস্ত্র মতে, যুগ রয়েছে চারটি এবং সেগুলো হলো: সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি। যুগের প্রারম্ভে বৈদিক দেবতা এবং স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের রাজ সভায় নাচ, গানসহ নানান বিনোদন কার্য সম্পাদন করতো কিন্নররা। কিন্নর শব্দের অর্থ হলো- দেবলোকের গায়ক জাতি।
বিভিন্ন উৎসবে নাচ, গান, ঢাকঢোল ও বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জীবীকা নির্বাহ করতো কিন্নর সম্প্রদায়ের মানুষ।
কিন্তু কালক্রমে নানা বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কারের ফলে সে পেশায় ভাটা পড়ে। নিয়মিত কাজ না পাওয়ায় পেট বাঁচানোই দায় হয়ে পড়ে। অনেকটা বাধ্য হয়ে পেশার রূপ বদল করতে হয় তাদের। গোয়াল ঘরে গরু,বাছুর কীভাবে রাখা যায় এবং কীভাবে রোগবালাই থেকে গরু বাছুরকে রক্ষা করা যায় সেজন্য গানে গানে খনার বচন বলেন বলে ওদের নাম কিন্নর থেকে গোয়ালি। আবার কেউ কেউ গোয়ালাও বলে থাকেন।
যুগ যুগ ধরেই দেশের উত্তরাঞ্চলের রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও ও পঞ্চগড় জেলার গ্রামীণ জনপদে কিষাণদের ছিল গোলাভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ ও গোয়াল ভরা গরু। গাভী দিত দুধ আর বলদ টানতো লাঙল ও গাড়ি। এজন্য কিষাণ-কিষাণীরা গরুর যত্নও নিতেন বেশ। ঠিক এসময়ে সুখী ও সমৃদ্ধ এ জনপদের বিভিন্ন গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় দেখা মিলতো ওই পেশার রূপ বদল করা গোয়ালিদের। রুজির অন্বেষণে সাত সকালে গোয়ালিরা বেড়িয়ে পড়তো তাদের চিরাচরিত পোষাক ধুতি পরে। কাঁধে ঝুলানো থাকতো মোটা কাপড়ের তৈরি একটি বড় ঝোলা। হাতে ছিল হাতল ওয়ালা একটি ছোট বাক্স আর জুড়ি। দূরদূরান্তে গিয়ে গ্রামের বিভিন্ন কিষাণ-কিষাণীদের উঠানে গিয়েই সেই জুড়ি বাজিয়ে সংকেত দিতো গোয়ালিরা। জুড়ির ঠুংঠুং শব্দে এবাড়ি ওবাড়ি থেকে ছুটে আসতো শিশু, কিশোর, কিশোরী ও বধূরা। কাউকেই কিছু না বলে সোজা গোয়াল ঘরের দরজায় গিয়ে বসতো আর সামনে রাখতো বাক্সে থাকা গাভী ও বাছুর সদৃশ মূর্তি। তারপর ছন্দে ছন্দে জুুড়ি বাজিয়ে শুরু করতো কী করলে কী হবে অর্থাৎ গোয়ালের গরু ও গৃহস্থের (স্বামী) মঙ্গল ও অমঙ্গল নিয়ে স্বরচিত নানান খনার বচন। পানি ভর্তি ঘটিতে চুবানো থাকা দুর্বা ঘাস ছিটিয়ে দিতো পুরো গোয়াল ঘরে। তাতে নাকি মঙ্গল গরু ও গৃহস্থের। আর দক্ষিণা হিসেবে পেত কুলা ভর্তি ধান, চাল বা গমের সাথে টাকা, পয়সা, পান ও সুপারি। ভরা মৌসুমে ধানও পেত নাকি কুড়ি মনের মতো। যা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন নির্বাহ করতো গোয়ালিরা।
বাস্তবতা হলো, গত দশক তিনেক থেকেই আর গ্রামীণ এ জনপদে দেখা মেলে না গোয়ালিদের। শোনা যায় না জুড়ির সেই টুংটুং শব্দ ও খনার বচন। কারণ বেড়েছে শিক্ষার হার ও চিকিৎসা সুবিধা। দূর হচ্ছে সমাজ থেকে সেই কুসংস্কার। আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের আবিষ্কার ও ইন্টারনেটের যুগে গোয়ালিদের গানে গানে গাওয়া ওই খনার বচন এখন আমাদের নিকট সেকেলে মনে হলেও পণ্যমূল্য বৃদ্ধিতে দিশেহারা হয়ে বাদ্য বাজানোসহ অন্যান্য কাজের ফাঁকে আবার গোয়ালি হিসেবে বেড়িয়ে পড়েছে দুই-একজন। দেখাও হলো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে পূর্ণা কিন্নর নামের এক গোয়ালির সাথে। আফসোস করে বলল, “যান্ত্রিক ও ইন্টারনেটের যুগে পরাজিত আমরা। কিন্নর সম্প্রদায় ছিল স্বর্গের রাজা ইন্দ্রের রাজ সভায় নাচ, গানসহ নানান বিনোদন কার্যে ব্যস্ত। আর সেই কিন্নর থেকে আজ আমরা গোয়ালি।