শীতের উগ্রতায় ক্ষত-বিক্ষত রুগ্ন প্রকৃতি। মাঠ ঘাট শস্য-শ্যামলে ঘেরা। বসন্তের আগমনে ছুটে আসে দক্ষিণা হাওয়া।বসন্তের হাওয়া পেয়ে ঝরে পড়ে বৃক্ষের রুগ্ন শুষ্ক পাতা। গাছের তলে পাতা কুড়ানি দের ধুম পড়ে যায়। পথের ধুলা বালি বাতাসে উড়ে সারা অঙ্গ ভরে। ঝির-ঝির বাতাসে আমের বকুল গাছের কচি কচি পাতা হেলে-দুলে নিত্য করে। হঠাৎ করে পূবেন বাতাসের আগমন। সারা আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। টিপ-টিপ করে বৃষ্টি ঝরতে ঝরতে দমকা হাওয়ায় এলোমেলো প্রকৃতি। লন্ডভন্ড প্রকৃতি যখন শান্ত তখন ঘর থেকে ছুটে আসে ষষ্ঠ শ্রেণির ফরিদ নামের ছেলেটা। সে শিমুল গাছের তলায় গিয়ে দেখে ফুল আর ফুল। গাছের দিকে চেয়ে দেখে বিভিন্ন পাখি আর ফুলের সমাহার। ফুল আর পাখিদের দেখে খুশিতে দিশাহারা। এক দৌড়ে সে বাড়ি চলে যায়। ফুল খুঁটবে কিসে? সেই পাত্র খুঁজতে ভীষণ ব্যস্ত! খুঁজতে খুঁজতে পেল একটি ধামা। ছেলেটি ধামা নিয়ে ফুল খুঁটতে শুরু করে। ধামা ভরতে সে বাড়ি রওনা দেয়। ফরিদের মাথায় ফুলে ভরা ধামা দেখে তার মা অবাক। এ ফুল দিয়ে কি করবে বাবা? মা কাল সকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই ফুল দিয়ে মালা গাঁথবো বলে এনেছি। এই গাঁথা মালা আমি শহীদ মিনারে দিব। আমার ভাই রফিক, জব্বার ,বরকত ,সালাম, শফিউর সহ নাম না জানা অনেক শহীদ ভাইদের আত্মা খুশি হবে।মা তার ছোট্ট ছেলের কথা শুনে তো অবাক। মা বলিল তোমার বাবা যেন না জানে। জানলে তোকে ভীষণ বকবে। ঠিক আছে মা। বাবার ভয়ে সব ফুল ঘরের পিছনে বড় বাগানে রেখে আসে। পড়ন্ত বিকালে বাগানে গিয়ে তার বন্ধু রতন,মহন,যাতন মিলে ফুলের ডালা সাজাতে লাগে। এর মধ্যে তার বাবা বাড়ি এসে পৌঁছায়। ফরিদের মার কাছে ফরিদের কথা জানতে চাইলে কোথায় আছে ভয়ে কিছু বলে না। তার বাবা যে তাকে খুঁজছে। এ খবর ফরিদের কানে পৌঁছে গেছে। এতে তার কোন মাথা ব্যথা নেই। সে ঠিকই ফুলের ডালা সাজানো শেষ করে সন্ধ্যার পরে বাড়ি ফেরে। ফরিদ বাড়ি যেতেই বাবা ডাক দিয়ে বলিল ফরিদ বাবু কোথায় ছিলে এতো সময় ? সে কি কথা? আপনি জানেন না রাত পোহালে আটই ফাল্গুন মানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ? হ্যাঁ জানিত! তাতে তোমার কি? বাবা আপনি যে কি বলেন? আমি এবার মাধ্যামিক বিদ্যলয়ে গেছি সেটা কি আপনার মাথায় আছে? আমাদের স্কুলের শিক্ষক রা বলেছে কাল একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সবাই কে ফুলের ডালা সাজিয়ে নিয়ে জেতে বলেছে। তাই আমি ফুলের ডালা সাজাতে গেছিলাম। এই কারণে বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়েছে।
ফরিদের বাবা এই কথা শুনে মুচকি মুচকি হেসে বলিল ও আচ্ছা এই কথা? ঠিক আছে। আনন্দে ফরিদের রাতে দুই নয়নে ঘুম ধরে না। কখন কোয়েলের কুহু তানে ভোর হবে? কখন পূর্ব গগনে সূর্য্যি মামা উঠার আগে সে উঠবে। কখন সে খালি পায়ে হেটে হেটে গিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিবে? ভাবতে ভাবতে দোয়েল কোয়েলের সুমিষ্ট কণ্ঠের তানে ভোর হয়ে যায়। ফরিদ স্কুলে যাওয়ার পথে অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা। ফরিদের ফুলের ডালা দেখে সবাই হাসতে হাসতে বাঁচে না। তবে কেন যে হাসছে ফরিদ বুঝতে না পেরে ওর সাথে থাকা তিন বন্ধুর কাছে জানতে চাই কিন্তু তারা ও বলতে পারে না। স্কুলে গিয়ে পৌঁছালে দেখে, এখানের ও সবাই তার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। শহিদ মিনারে ফুলের ডালা দিতে গেলে বড় ভাইদের বাঁধা। কারণ? এই ফুল দিয়ে কেউ কাউকে কোন দিন সম্মান দেখায়? কখনো দেখেছো? দেখছ না? সবাই গাঁদা ফুল দিয়ে ডালা সাজিয়ে এনেছে। এর মধ্যে নিত্য আনন্দ স্যার এসে বলিল কি রে? কি হয়েছে? দশম শ্রেণির ছাত্র মো: মেহেদি হাসান বলিল স্যার দেখেন না এই ছেলে কি ফুলের মালা এবং ডালা সাজিয়ে এনেছে? নিত্য আনন্দ স্যার বলিল এই ফুলই তোমাদের সমস্যা? জি স্যার! ঠিক আছে সমস্যা আমি সমাধান করছি আগে ওদের শহীদ মিনারে ফুল দিতে দাও। ফুল দিয়া হলে সবাই কে নিয়ে দশম শ্রেণিতে এসো। এর মধ্যে অষ্টম শ্রেণির একটি ছেলে তাচ্ছিল্য করে ডাকতে লাগলো পলাশ ফলের ডালা দেখো এবার জ¦ালা। নিত্য আনন্দ স্যার এই কথা শুনে আরো রাগাšি^ত হল। সবাই দশম শ্রেণিতে এলে নিত্য আনন্দ স্যার কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। মেহেদী তুমি বলো সালাম, বরকত,রফিক,জব্বার,শফিউল নাম না জানা অনেকে শহীদ হয়েছে কেন? মাতৃভাষার জন্যে। গাঁদা ফুল দিয়ে কেন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাও বলতে পারবে? না স্যার! অষ্টম শ্রেণির বাইজীদ তুমি বলতে পারবে? না স্যার! ক্লাসের আর কেউ পারবে? কারুর নিকট থেকে কোন উত্তর এলো না। মেহেদী তুমি বলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস বাংলায় কবে পালিত হয়? স্যার ফেব্রæয়ারি মাসের একুশ তারিখে। বাইজীত তুমি বলতে পারবে? না স্যার! এখানে আর কেউ আছো যে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? ফরিদ দাঁড়িয়ে বলিল জি স্যার আমি পারবো।ঠিক আছে বলো। ফাল্গুন মাসের আট তারিখ আমাদের মাতৃভাষা দিবস। কে তোমাকে বলেছে ? আমার বাবা! তোমার বাবা কি করেন? প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। সবাই গাঁদা ফুল দিয়ে শহিদের শ্রদ্ধা জানাতে আসছে। তুমি কেন শিমুল ফুল দিয়ে শহিদ দের সম্মান জানাতে এসেছ বলতে পারবে? জি স্যার! আমার দাদা একদিন বলেছিল মাতৃভাষার জন্য অনেক মানুষ রাজ পথে রক্ত দিয়েছে। অনেক ভাইদের জীবন দিয়ে এই মাতৃভাষা ছিনিয়ে আনতে হয়েছে । সে কথা আমি মনে রেখেছি। আগামী কাল মাতৃভাষা দিবস। কোথায় ফুল পাবো সেই সন্ধানে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি রাজ পথ যেন রক্তে রঞ্জিত। কাছে গিয়ে দেখি শিমুল ফুল যেন রক্তের বন্যায় ভেসে গেছে রাজ পথ । এই ফুল দেখে শহিদ দের রক্ত এবং জীবন দানের কথা মনে পড়ে যায়। যে ফুল আমাদের স্মৃতি মনে করে দেয় সেই ফুল দিয়ে শহিদ দের শ্রদ্ধা জানাবো বলে সিদ্ধান্ত নি। তার পর সব ইতিহাস। ফরিদের কথা শুনে শিক্ষক সহ ছাত্র-ছাত্রী সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়।