আজ বিশ্ব খাদ্য দিবস। খাদ্য নিরাপত্তায় নজিরবিহীন বিপর্যয় আর খাদ্যপণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির মধ্যেই সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হচ্ছে। তাই এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে ‘কাউকে পশ্চাতে রেখে নয়; সবার জন্য উত্তম পুষ্টি, সুরক্ষিত পরিবেশ এবং উন্নত জীবন’। এ অবস্থায় জাতিসংঘ, আঞ্চলিক সংস্থা ও সরকার মানুষকে দরিদ্রতা থেকে বের করে আনতে আগাম প্রস্তুতিকেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈশ্বিক অর্থনীতির এ হালের জন্য ইউক্রেন যুদ্ধ আর পরাশক্তিগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টানিষেধাজ্ঞাকেই কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পরিস্থিতি মোকাবিলায় তিনি দেশের মানুষকে প্রতি ইঞ্চি জমিতে শস্য আবাদের পরামর্শ দিয়েছেন যাতে করে উৎপাদন বাড়িয়ে মানুষ সঞ্চয় করতে পারে।
এদিকে, দামের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক আছে চাহিদা ও সরবরাহের। যেখানে জনসংখ্যা আর খাদ্য চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে আবার পানির স্বল্পতা, মাটির গুণাগুণ কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন, নতুন প্রজন্মের কৃষিকাজে অনীহাসহ নানা কারণে চাষের জমি কমে যাচ্ছে।
সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুতগতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। বিশ্বব্যাংক যে আশঙ্কা করেছে, তা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাটি বলছে, সম্ভাব্য এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলো। প্রতিবেদনে জাতিসংঘের অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, উন্নত দেশগুলোর মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতি বিশ্বকে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চেয়েও খারাপ অর্থনৈতিক মন্দায় ফেলতে পারে।
প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য মন্দার কারণ উন্নত অর্থনীতিগুলোর খারাপ নীতিগত সিদ্ধান্ত, জলবায়ু পরিবর্তন, কোভিড-১৯ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাড়তে থাকা সংকট। তারা অনুমান করেছেন, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২০২৩ সালে কমে ২ দশমিক ২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াবে। ফলে মোট ১৭ লাখ কোটি ডলার ঘাটতি দেখা দেবে, যা বিশ্বের মোট আয়ের ২০ শতাংশের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস বলেছেন, মন্দা এড়ানো অনেক দেশের পক্ষেই কঠিন হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে যাওয়ার পাঁচটি লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, বিশ্ব আরেকটি অর্থনৈতিক সংকটের দিকে যাচ্ছে।
জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন গ্রিফিতের মতে, যখন দুর্ভিক্ষ দরজায় আসে, তখন এটি ভাইরাল হয়ে ওঠে। আর ক্রমবর্ধমান দরিদ্রতা আর খাদ্যের উচ্চমূল্যে ঝুঁকিতে পড়ে মূলত নারী ও কন্যাশিশুরাই বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পড়ে। পরিবারের সদস্যদের খাদ্যের জোগান দিতে নারীদের মরিয়া চেষ্টা চালাতে হয়। এর মধ্যে খাদ্যের জন্য যৌনতা যেমন আছে, তেমনি অনেককে বাল্যবিবাহের শিকার হতে হচ্ছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) মহাপরিচালক বলছেন, কৃষি খাদ্য পদ্ধতিতে সহায়তা, দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে এবং নষ্ট করার মতো সময় এখন নেই।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে আমেরিকা ও রাশিয়ার নানা পদক্ষেপের কারণে এরই মধ্যেই অর্থনীতিতে নানা প্রভাব পড়েছে এবং দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অনেকখানি। সামনে সংকট আরো বেশি হলে অর্থনীতির অবস্থা কেমন দাঁড়ায় তা নিয়ে তাই বেশ উদ্বেগ আছে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।
জাতিসংঘ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মন্দার আশঙ্কা থেকে এখনই চিন্তা করা হচ্ছে আগামী বছরের বাজেট নিয়ে।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র সফর থেকে ঢাকায় ফিরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি ব্রিটেনের রানির শেষকৃত্যানুষ্ঠান ও জাতিসংঘের অধিবেশনের সময় বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের সঙ্গে বৈঠকের কথা উল্লেখ করে জানান, তারা বিশ্বময় একটি দুর্ভিক্ষের আশংকা করছেন এবং ২০২৩ সালে দুর্যোগময় সময় ঘনিয়ে আসছে বলে মনে করেন। তবে তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশের এ মুহূর্তে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো, যা দিয়ে পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। কিন্তু বিশ্ব যদি সমস্যায় থাকে সেক্ষেত্রে আমরা কি ভালো থাকব? এ জন্য মানুষের কষ্ট লাঘবে যা করা দরকার তার সব উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। আগামী বাজেট নিয়েও এখনই চিন্তা করা হচ্ছে।
এদিকে, ওয়াশিংটন থেকে গত মাসেই বিশ্বব্যাংক তার ‘বিশ্বে কি মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির তিন মূল চালিকাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরোপের অর্থনীতি দ্রুত গতি হারাচ্ছে। ফলে আগামী বছরে সামান্য আঘাতেও মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
বিশ্বব্যাংক এ বিষয়ে যে আশংকা করেছে সেটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বৈশ্বিক এ সংস্থাটি বলছে, সম্ভাব্য এই মন্দায় মারাত্মক পরিণতি ভোগ করবে মূলত উঠতি বাজার ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি।
প্রধানমন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে তার একাধিক বক্তব্যে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক মন্দার কথা বলে মূলত খাদ্য সংকটের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশিদের কয়েকটি অনুষ্ঠানে তিনি দেশবাসীকে তাদের অব্যবহৃত জায়গা-জমিতে শস্য আবাদের পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক সায়মা হক বিদিশা বলছেন, বাংলাদেশের সামনে কয়েকটি বিষয় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসবে।
এগুলো হলো : রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। আমদানি করা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে। মন্দায় বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলে তার সঙ্গে দেশের বাজারের সমন্বয় সাধন করা। রেমিট্যান্স কমতে পারে। বিশ্ব অর্থনীতি মন্দায় পড়লে বাংলাদেশের রপ্তানিতে এর প্রভাব পড়বে কারণ তৈরি পোশাকের চাহিদা কমবে। তবে সঠিকভাবে এগুতে পারলে এখানে কিছুটা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হবে।
সায়মা হক বিদিশার মতে, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বড় অংশ তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে থাকলেও বৈশ্বিক মন্দায় তাতেও প্রভাব পড়তে পারে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের কোম্পানিগুলো পশ্চিমাদের কাছে যে রপ্তানি করে তাতে প্রবৃদ্ধি কম হলে এসব কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশংকা তৈরি হবে। এছাড়া বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে খাদ্যপণ্যের দাম। কারণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যপণ্য বাংলাদেশকে আমদানি করতে হয়।
সায়মা হক বলেন, বৈশ্বিক মন্দা দেখা গিলে খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে সেটি প্রভাব ফেলবে। আমদানি করা পণ্যগুলোর দাম বাড়বে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বৈশ্বিক মন্দায় কমে এলে সেটি কিছু স্বস্তিরও কারণ হতে পারে। তবে সম্ভাব্য বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে যদি দেশের সার্বিক রপ্তানি আয় কমে আর আমদানি আয় বেড়ে যায় তাহলে আবার ডলার সংকট তৈরি হতে পারে। তবে বাংলাদেশের বাজারে সমন্বয়টা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করতে পারলে সাধারণ মানুষ স্বস্তি পাবে। কৃষি আর রেমিট্যান্সে প্রণোদনাসহ আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ ঠিকমতো নিতে পারলে মন্দার চাপ মোকাবিলা কিছুটা সহজ হবে। একই সঙ্গে চলতি বছর ডলার সংকট মোকাবিলায় যেভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে সে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে।