মানুষের জীবন চক্রের চমৎকার একটি চিত্র দেখেছিলাম ‘জনসংখ্যা অর্থনীতি’ বইয়ের প্রচ্ছদে। জন্ম থেকে স্বাভাবিক মৃৃৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষকে যে কয়েকটি ধাপ পেরুতে হয় তার সবই রয়েছে ওই চিত্রে। যেখানে স্থান পেয়েছে ষাটোর্ধ্ব মানুষের জীবন কালও। আমাদের দেশে সাধারণত ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত কর্মক্ষম হিসেবে বিবেচনা করা হলেও অনেক উন্নত দেশে তা ৬৪ বছর বা তদুর্ধ্ব। কোনো দেশে মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মানুষ যদি এমন বয়সের হয় তখন সেই দেশকে প্রবীণ জনসংখ্যার দেশ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সেদিক থেকে প্রবীণদের সংখ্যা এখন আর শুধু ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ বা এশিয়ার জাপানেই নয়, বাংলাদেশেও দিন-দিন বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা।
গত বছরের মে মাসে ইউনিসেফ প্রকাশিত এক রিপোর্ট বলছে, বাংলাদেশ প্রবীণপ্রবণ সমাজে পদার্পণ করবে ২০২৯ সালে। আর সেখান থেকে ধীরে ধীরে প্রবীণপ্রধান সমাজে পরিণত হবে ২০৪৭ সালে। মাত্র ১৮ বছরের মধ্যে এই পরিবর্তন ঘটতে চলেছে আমাদের দেশে। বিশ্বে এমন সব দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
সে যাই হোক, পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তি সুদৃঢ় করণে চালিকাশক্তি হিসেবে যাঁদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য সেই তাঁরাই কিনা অবসর গ্রহণ করলেই অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সামিল হচ্ছেন নির্ভরশীল জনসংখ্যার কাতারে। পরিবার ও সমাজে অনেক প্রবীণ রয়েছেন- যাঁরা তাঁদের নিজ সন্তান, পুত্রবধূ, জামাতা, নাতি-নাতনি এমনকি জীবনসঙ্গীর কাছেও তাঁদের প্রতিনিয়ত বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন ৷ উপেক্ষিত হচ্ছেন মানবিক দিক থেকে। থাকছেন একাকী, ভুগছেন নিঃসঙ্গতায় আর বিষাদময় হয়ে পড়ছে প্রবীণদের জীবন।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর ‘প্রতিদিনের সংবাদ’ পত্রিকার অনলাইনে এক ভিডিও সংবাদে দেখা গেছে, বগুড়ার নন্দিগ্রামে তিন তিনটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসর প্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রশিদের দ্বিতীয় স্ত্রী , এক মেয়ে ও শ্বাশুড়ি জমিজমা লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ১ বছর ধরে ৮৮ বছর বয়সী প্রবীণ ওই শিক্ষক যাত্রীছাউনিতে অনাহারে,অর্ধাহারে ও অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে আছেন। গত জুলাই মাসের ৭ তারিখে ঢাকার মগবাজারের একটি ফ্ল্যাটের ৭ তলায় দরজা ভেঙে ইকবাল উদ্দিন নামে বাহাত্তর বছর বয়সী এক চিকিৎসকের গলিত লাশ তার নিজের বাসা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। দুই ছেলে, মেয়ে ও স্ত্রী দেশের বাইরে থাকলেও অসুস্থ অবস্থায় একাই ওই বাসায় থাকতেন তিনি। ৯৯৯-এ কল পেয়ে ওই চিকিৎসকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি আবু মোহসিন খান নামে এক ব্যক্তি ধানমন্ডির নিজ ফ্ল্যাটে ফেসবুক লাইভে মাথায় পিস্তল দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। তিনিও ছিলেন নিঃসঙ্গ। গত বছরের ১৭ এপ্রিল উত্তরার বাসা থেকে পুলিশ অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। এই খ্যাতিমান রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও একাই থাকতেন তাঁর ফ্ল্যাটে- এমন খবরগুলো নাড়া দিয়েছে মানুষের বিবেককে। অথচ পরিবার ও সমাজে প্রবীণদের রয়েছে সেবাযত্ন ও সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার; দীর্ঘ সময় পরিবারের সাথে বাড়িতে থাকার অধিকার; খাদ্য, নিরাপত্তা ও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারসহ নানা সব অধিকার। কিন্তু ঠিকমতো পাচ্ছেন না তা। কারণ- দশক তিনেক আগেও আমাদের সমাজে পরিবারগুলো ছিল যৌথ বা একান্নবর্তী। বলা যায়, সেই সময় পরিবারে একক কর্তৃত্ব ছিল প্রবীণদের। কিন্তু দ্রুত শিল্পায়ন, নগরায়ন ও জীবনধারার পরিবর্তনের ফলে পরিবারগুলো ভেঙে গঠিত হচ্ছে অনু পরিবার। স্বামী, স্ত্রী ও তাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে গঠিত এমন অনু পরিবারে স্থান হচ্ছে না বৃদ্ধ বাবা, মা বা শ্বশুর,শাশুড়ির।
ফলে নাতি, নাতনিদের নিয়ে নানা রূপকথার গল্প করে সময় কাটানোর সুযোগ ভাগ্যে আর জুটছে না প্রবীণদের। শুধু কী তাই! অর্থনৈতিক জীবনধারায় পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগায় অনেক পরিবারেই স্বামী, স্ত্রী উভয়েই এখন কর্মজীবী। তাই তাদের সন্তানদের স্কুলে আনা-নেওয়া, দেখাশুনা, বাজার করাসহ পরিবারের নানা কাজের দায়িত্বও পড়ছে প্রবীণদের ওপর। কর্মক্ষম বয়সে তাঁরা এগুলো করতে করতে এখন পরিশ্রান্ত, ক্লান্ত। শেষ বয়সে এসে সেই একই কাজগুলো করা সত্যি সত্যিই তাঁদের জন্য বেশ দুরূহ ব্যাপার। আবার, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরে নানা ধরণের ব্যধিও দানা বাঁধতে শুরু করে তাঁদের। ঘাটতি দেখা দিচ্ছে প্রবীণের দেখাশোনা, সেবাযত্ন বা চিকিৎসায়। গল্প করার লোকজনও থাকছে না তাঁদের পাশে। ফলে নিঃসঙ্গতা বা একাকীত্বতা গ্রাস করে ফেলছে প্রবীণদের। দূর্বিসহ হযে উঠছে তাঁদের জীবন।
এক সময় দেখতাম, সমাজে প্রবীণদের মতামতের বেশ গুরুত্ব ছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদের ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত। বাড়িতে তো বটেই, এমনকি পথে-ঘাটে, হাট-বাজারে, পাড়ায়-মহল্লায় প্রবীণরা ছিলেন সম্মানিত। এখন তাঁরা নাকি কিছু বোঝেন না! আমরাও যে একদিন প্রবীণের কাতারে শামিল হবো বেমালুম ভুলে যাচ্ছি তা। কী দুর্ভাগ্য আমাদের সমাজের! বস্তুত এগুলো সবই আমাদের আত্নকেন্দ্রিক মনোভাবের প্রসার, সামাজিক মুল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ও ভিনদেশি সংস্কৃতির বিষময় প্রভাব পড়েছে সমাজে। বোঝা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে প্রবীণদের। অবসর যাপন বা বিনোদন তো দূরের কথা, তাঁদের পাশে বসে একটু সুখ-দুঃখের গল্পও করার কোনো সুযোগ নেই যেন কারো!
অর্থনৈতিক দিক থেকে এক সময় যাঁরা ছিলেন আয়-উপার্জনে ব্যস্ত, হাতে থাকতো টাকা-পয়সা, করতেন পরিবারের ভরণপোষণ, লেখাপড়াসহ অন্যান্য ব্যয়ভার বহনে যাঁদের হাত ছিল উদার সময়ের পরিক্রমায় তাঁরাই বার্ধক্যে এসে আজ হয়ে পড়ছেন রিক্ত। তাকিয়ে থাকতে হয় সন্তানের করুণার দিকে। সম্পদ ভাগাভাগি নিয়ে টানাটানি চললেও টানাটানি হয় না কেবল প্রবীণদের সেবাযত্ন করা নিয়ে। আবার দেখা যায়, অর্থসম্পদের অভাব না থাকলেও দেখা পান না তাঁরা প্রিয়জনের। তো কী করবেন প্রবীণরা ওই প্রিয়জন ও অর্থসম্পদ দিয়ে, যারা দুঃসময়ে কাজে আসছে না তাঁর। এমন চিন্তা যখন পেয়ে বসে নিজেকে তখন বড্ড অসহায় বলে ভাবতে শুরু করেন তাঁরা। তবে গ্রামে এখনো প্রবীণদের একাকিত্বে ভোগার নজির খুব একটা দেখা যায় না। পারিবারিক বন্ধনটা শহুরে জীবনে আলগা হলেও গ্রামে ততটা আলগা হয়ে যায়নি এখনো।
আদমশুমারি রিপোর্ট ২০০১ অনুযায়ী দেশে ৬০-৬৫, ৬৫-৬৯ এবং ৭০ উর্ধ্ব বয়স দলে জনসংখ্যার শতকরা হার শহরাঞ্চলের তুলনায় গ্রামাঞ্চলে বেশি। তার আগে ১৯৮১ এবং ১৯৯১ সালের শুমারিতেও এমন বয়সীদের হার বেশি ছিল ওই গ্রামাঞ্চলেই। গ্রামাঞ্চলে প্রবীণরা ছেলে, মেয়েসহ যৌথ বা একান্নবর্তী পরিবারে বাস করেন, কিন্তু শহরাঞ্চলে এমন পদ্ধতির চর্চা খুব কমই লক্ষ্য করা যায়। ফলে শহরে প্রবীণের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
খাদ্য নিরাপত্তা, চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি ও শিশু মৃত্যু হার কমে যাওয়ায় মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২। ফলে বাড়ছে প্রবীণের হারও।জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ তথ্য অনুযায়ী দেশে ষাটোর্ধ্ব মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯ জন, যা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ২০২১ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ১৮ মিলিয়ন এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ৪০ মিলিয়নে। প্রায় বছর আটেক আগে সমাজ ও রাষ্ট্রে অবদান রাখার জন্য শ্রদ্ধা প্রদর্শনে সমাজের সকল প্রবীণদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
যাই হোক, দেশে চিকিৎসা সেবার উন্নতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। বাড়ছে ‘সিনিয়র সিটিজেন’ এর সংখ্যা। গড় আয়ু বাড়ায় তাঁদের কর্মক্ষমতাও বাড়ছে। তাই প্রবীণ নাগরিকদের অবসরের পর সেই কর্মক্ষমতা কাজে লাগানোর ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে পরিবার ও সমাজকে। মাত্র ৫শ টাকা ভাতা যে যথেষ্ট নয় তা নিয়ে ভাবতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। পরিকল্পনা করতে হবে সরকারি ও বেসরকারিভাবে। সরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচির অধীনে দেশের প্রবীণদের জন্য কল্যাণকর কার্যক্রম গ্রহন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে ব্যাংক, হাসপাতাল, আদালতসহ সব নাগরিক সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার। কোনো প্রকার হয়রানি ছাড়াই নিষ্পত্তি করতে হবে অবসরপ্রাপ্তদের অবসর সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি। সুদৃঢ় করতে হবে পারিবারিক বন্ধন। ব্যবস্থা করতে হবে সেবাযত্ন ও চিকিৎসার। আবার যেন সন্ধ্যে বেলা পাটী বিছিয়ে আদুরে নাতি-নাতনিদের সেই রূপকথার গল্পগুলো বলতে পারেন তাঁরা সে ব্যবস্থাও করতে হবে পরিবারকে। শুধু মুখে নয়, সত্যিকারভাবে প্রবীণ নারিকদের সম্মান এবং মূল্যায়ন করতে হবে পরিবার ও সমাজে। তবেই হয়তো প্রবীণরা একটু আনন্দ আর মানসিক প্রশান্তি নিয়ে প্রিয়জনদের সাথে কাটিয়ে দিতে পারবেন জীবনের অবশিষ্ট সময়। আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসে সেটিই সবার প্রত্যাশা।