রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৪ অপরাহ্ন

ই-পেপার

রাজনীতির কারণেই সুশীল সমাজ নিরপেক্ষতা হারাচ্ছে! দু:শীল সমাজের উথ্থান !

মাহবুব-উল-আলম, সাংবাদিক ও গবেষক:
আপডেট সময়: শুক্রবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১১:২২ পূর্বাহ্ণ

গোপাল ভাঁড় একদিন রাজসভায় এসে বলল,“মহারাজ আজ একজন সুশীল বালকের দেখা পেয়েছি।” মহারাজ বললেন,তুমি কি করে বুঝলে সে সুশীল বালক ? গোপাল বলল,বাপ আর ছেলে মাঠে কাজ করছিল । কিছুক্ষণ কাজ করার পর ছেলে বাবাকে বলল, “বাবা,তুমি একটু দূরে সরে যাও,আমি এখন গাঁজা টানব। গুরুজনদের সামনে কখনো গাঁজা টানা উচিৎ নয়।” এবার আপনি বলুন,ছেলেটি সুশীল কিনা ?

সুশীল সমাজের লোকেরা গাঁজা ভাং খায় কিনা জানা নেই। তবে তারা অনেক কাজই করেন যা সাধারণ মানুষ করে না। সুশীল সমাজ আর সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবন-যাপন। তাদের চাওয়া-পাওয়া খুবই সামান্য। মৌলিক চাহিদা পূরণ হলেই তারা সন্তষ্ট। জাতীয় নির্বাচনের ভোট অন্য কেউ দিয়ে দিলেও তারা খুব একটা ওজর আপত্তি করে না। অথচ সংবিধানে সকল নাগরিকের সমানাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

সুশীল সমাজের লোকেরা রাষ্ট্রের গূরুত্বপূর্ণ অংশ। অনেকেই আবার একে রাষ্ট্রের তৃতীয় বিভাগ হিসাবে বুঝে থাকেন। তারা সরকারের ভুলত্রুটি ধরিয়ে দেয়। সমালোচনার মাধ্যমে সঠিক পদক্ষেপ নিতে সাহায্য করে। তারা সমাজের সচেতন ও শিক্ষিত অংশত বটেই। এঁরা সমাজের কোন ব্যক্তি বা সংগঠন যা সরকার-নিরপেক্ষ হয়ে থাকে।

সুশীল সমাজ শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়,ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলে এবং মানবতার সম্মান করে। আদর্শ ও ভাবার্থ অনুযায়ী এরকম সমাজকেই সুশীল সমাজ বলে। অবশ্য সুশীল সমাজের আড়ালে দু:শীল সমাজও রয়েছে। অনেক গণতান্ত্রিক ও ধর্মান্ধ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা সহিংস ও বিদ্বেষ ছড়ায়। গোপনে জনগণের স্বার্থ বিকিয়ে দেয়। এমন লোকের প্রাধান্য রাজনীতিতে এলে অবস্থা হয় তথৈবচ।

ফরাসি রাজনীতিবিদ ও ঐতিহাসিক আ্যলেক্সিস দ্য তোকভিল (১৮০৫-১৮৬৯) মার্কিন শাসন পর্যবেক্ষণের পর তিনি মনে করেন,ব্যক্তির অধিকার রক্ষার জন্য গণতন্ত্র যথেষ্ট নয়। অনেক সময় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার হরণ করে। এই ধরণের পরিস্থিতিকে তিনি (Tyranny of the majority)  বা সংখ্যাগুরুর স্বেচ্ছাচার বলে অভিহিত করেছেন। এই পরিস্থিতি প্রতিরোধের জন্য সুশীল সমাজের ভুমিকা অত্যন্ত জরুরী। সমস্যা যেটা তা হলো রাজনৈতিক দলগুলো সিভিল সমাজেরই অংশ। অথচ সুশীল সমাজের অবস্থান রাষ্ট্রযন্ত্রের বাইরে।

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এজন্য সুশীল সমাজের সদস্যদের আর নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব হয়না। যতদিন যাচ্ছে সুশীল সমাজ তার চরিত্র হারাচ্ছে। যেসব রাষ্ট্রে দল প্রধান ও সরকার প্রধান সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তি কেবল সেখানে দলের স্বতন্ত্র অস্তিত¦ সম্ভব। বাংলাদেশ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অথচ আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে গোটা সিভিল সমাজকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়। সিভিল সমাজ মাথা তুলতে চাইলে তাদের উপর দমন পীড়ন করা হয়। স্টাইল্স এর মতে,এসব দেশের সিভিল সমাজ হলো ফরমায়েশি সিভিল সমাজ (Civil society by design)। যারা বেশির ভাগ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনে কাজ করেন।

শিক্ষক,সাংবাদিক,রাজনীতিক,স্বেচ্ছাপ্রণোদিত সংগঠন হিসাবে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও সমবায় সমিতিগুলোকে সুশীল সমাজের সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এদের শতকরা ৯০ ভাগ দলের লেজুরবৃত্তির সাথে সম্পৃক্ত। এতটাই দৃশ্যমান যে,পূর্বের কেয়ারটেকার সরকার বা সামরিক সরকারগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায় তখন সুশীল সমাজের প্রাধান্য বেড়েছিল। কারণ তখন রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান ছিল দুর্বল। ভাল সরকার বা মন্দ সরকার যারাই ক্ষমতায় থাকুক না কেন ক্ষমতায় যাবার আগে সামরিক ও আমলা ব্যতীত সকল রাজনীতিক সুশীল সমাজের অংশ ছিল। তাই বলা হয়,‘যে যায় লংকায় সেই হয় রাবন’ !

আমরা মনে করি,তারপরও হারাবে না সুশীল সমাজ। যারা সর্বোত্তম,সৃজনশীল,নীতি নৈতিকতায় সমৃদ্ধ ,চেতনায় উদ্দীপ্ত তারাই অপ্রতিরোধ্য থেকে যাবে। এ ধরনের মানুষের কথা স্মরণ করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,“ যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে ,তবে একলা চলো রে।’
নিরপেক্ষতার কি তাহলে কোন মূল্য নেই! এরিষ্টটলের ভাষায়,“ যে সমাজে বাস করেনা,সে হয় পশু, না হয় দেবতা!” তেমনি সুশীল সমাজের সদস্যদের মধ্যেও রাজনৈতিক চরিত্র অপরিহার্য মনে করা হয়। নিরপেক্ষ ব্যক্তি যতই ন্যায়-নীতি ও স্বাধীন সার্বভৌমত্বের কথা বলুক,ক্ষমতাসীনদের কাছে তা নেতিবাচকই মনে হয়!

ধরা যাক, সুশীল সমাজের মি: এক্স একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসাবে রাজনীতিক-জনপ্রতিনিধির ভুয়সী প্রশংসা করলেন। তার সম্পর্কে গুণ-গান গেয়ে অনেক প্রতিবেদন তৈরি করে তা মিডিয়ায় প্রকাশও করলেন কিন্তু মি: এক্স নিজে দলের লেজুরবৃত্তি করেন না। তাহলে বানের জলের মত সব কৃতজ্ঞতা ধুয়ে মুছে যাবে। এভাবেই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সর্বদা হৃদয় ভাঙ্গে।

চন্ডিদাস বলেছেন,“সবার উপরে মানুষ সত্য,তাহার উপরে নাই।” এ কথার মর্মানুযায়ী মানুষের সম্মান মানুষ না দিলে মানবতা মিথ্যা হয়ে যায়। মানুষের জন্য রাষ্ট্র,সরকার,সংবিধান,স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব । এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেনা যে,একটি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সুশীল সমাজের ভুমিকা অগ্রগন্য। তাই রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই সুশীল সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

শোনা যায়, ‍প্রাচীন কালে বিচার বাদশা মাথা পেতে নিতেন। কারণ তাদের বিচার ছিল ন্যায় নিরপেক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত। একজন শিক্ষকের শির উঁচু করে দিয়েছেন বাদশা আলমগীর। প্রথিতযশা এমন অনেক বিচারক ও শিক্ষকের জন্ম হয়েছে আমাদের দেশে। তারাও সুশীল সমাজের মুকুট। তাদের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষা করেই সামনের পথ কন্টকমুক্ত রাখতে হবে। তবেই দু:শীল সমাজের উথ্থান রুখে দেওয়া সম্ভব হবে।

নিয়মতান্ত্রিক সরকারের মেয়াদ চার বা পাঁচ বছরের বেশি নয়। ভিন্ন পথে ক্ষমতায় থাকতে নাগরিক ভোটাধিকারের পরিবর্তে প্রশাসনযন্ত্রের উপর নির্ভরশীল রাজনৈতিক সরকারের দুর্বল ভিত্তি রচনা হয়। ফলে এই ধরনের সরকার ভেঙ্গে পড়লে তাদের নির্মম পরিনতি ঘটে। তখন তাদের আর সুশীল সমাজেও ফেরা হয়না,তাদের স্থান হয় শ্রীঘরে! ইতিহাসের এমন পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে। আমাদের কাম্য রাজনীতিকরা ক্ষমতা শেষে সুশীল সমাজেই ফিরে আসবেন।

লেখক : সরকারি হাজী জামাল উদ্দিন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর