গলগন্ডের বর্ননা:
গলায় অবস্হিত প্রজাপতির আকৃতির থাইরয়েড গ্রন্হি মস্তিস্ক ও বিপাক ক্রিয়ার কার্য়ক্রম পরিচালনায় হরমোন উৎপাদন করে। এই থাইরয়েড হরমোনের নিঃস্বরণে তারতম্য হলে দুই ধরনের রোগ হয়। একটি হলো গঠনগত অপরটি হলো কার্যগত। গঠনগত বিশৃংখলায় থাইরয়েড গ্লান্ডটি ফুলে যায়, যাকে আমরা গলগন্ড বা ঘ্যাগ বা গোয়েটার বলি। এটি থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ। থাইরয়েড গ্রন্থিটি দেহের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেহে যে ক’টি অন্তঃক্ষরা গ্রন্থি দেহের সামগ্রিক ক্রিয়াকে প্রভাবিত করে থাইরয়েড তাদের অন্যতম। এটি অন্য অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকেও প্রভাবিত করে। থাইরয়েড গ্রন্থিটি পক্ষান্তরে পিটুইটার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় যা আবার হাইপো থাইরয়েড গ্রন্থির নিয়ন্ত্রণে থাকে। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে থা্ইরয়েড (টি ৪ ও টি ৩) নিঃসৃত হয়। থাইরয়েড গ্রন্থি বিভিন্ন কারণে অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। এর মধ্যে অন্যতম হল পিটুইটারি গ্রন্থি হতে অধিক হরমোন তৈরী হয়। আবার খাদ্যে আয়োডিনের অভাব থাকলেও থাইরয়েড গ্রন্থিটি ক্রমশ বড় হতে থাকবে। এছাড়া থাইরয়েড গ্রন্থির কিছু কিছু স্থানিক সমস্যার কারণে গ্রন্থিটি ক্রমশই বড় হতে থাকে। এর মধ্যে আছে নড্যুল, ক্যান্সার, হাইপার থায়রয়েজিম ও হাইপো থাইরয়েডিজম। কিছু কিছু ওষুধও থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্ধির কারন হতে পারে।
গলগণ্ডের লক্ষণ:
গলগন্ড হঠাৎ করে শুরু হয় না ধীরে ধীরে এই রোগ হতে থাকে। এর প্রধানতম লক্ষণ হল গলার সামনের দিকের মাঝখানের নিচের অংশ বা দু’পাশ ফুলে উঠা। রোগী সাধারণত নিজে থেকে প্রথমে এ সমস্যাটি সনাক্ত করতে পারে না। তার বন্ধুবান্ধব বা ঘনিষ্ঠজন প্রথমে একবার গলার এ স্ফীতিকে সনাক্ত করে। এটি এত ধীরে ধীরে হয় যে, অন্য কেউ বলার পরও রোগী সন্দিহান থাকতে পারেন। কিন্তু তারপর দেখা যাবে এ গ্রন্থিটি ক্রমশঃ বৃহদাকার হয়ে যাচ্ছে। থাইরয়েড গ্রন্থির বৃদ্দি প্রাপ্তির সাথে সাথে খেতে বা ঢোক গিলতে সমস্যা দেখা দিতে পারে। গলগন্ড খুব বড় হলে শ্বাস-প্রশ্বাসেও সমস্যা হতে পারে। মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ও গর্ভাবস্থায় গলগন্ড সাময়িকভাবে বড় হয়। গলগন্ড হাইপার থাইরয়েডিজমের হলে থাইরয়েড গ্রন্থির নিরসনের পরিমাণ বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে বেশির ভাগ রোগীর কিছু অটোইম্যুন রোগ থাকে যার মধ্যে গ্রেভস রোগ প্রধান। এ সব রোগে টিএসএইচ- এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে গ্রন্থি থেকে অতিরিক্ত পরিমাণে টি৪ ও টি৩ হরমোন নিঃসৃত হতে থাকে। হাইপার থাইরয়েডিজমের গলগণ্ডে উপর লক্ষণগুলোর সাথে অনিয়মিত হৃদস্পন্দন, অস্থিরতা, দ্রুত ওজন কমে যাওয়া,গরম অসহ্য লাগা, হাত কাপা ও ডায়রিয়া থাকতে পারে। হাইপো থাইরয়েডিজম কারণে গলগন্ড হলে থায়রয়েড গ্রন্থির নিঃসরন কমে যায়। ক্রমবর্ধমান চাহিদা সামলাবার জন্য থায়রয়েড গ্রন্থি আয়তন বাড়তে থাকে। আয়োডিনের স্টাটাড এর প্রধান কারণ। এছাড়া কিছু অটোইম্যুন রোগও এর জন্য দায়ী। এ ক্ষেত্রে গলগন্ডে সাধারণ লক্ষণ গুলোর সাথে শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদ, শীত সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি থাকতে পারে। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে থাইরয়েড গ্রন্থির ক্যান্সারের জন্যও গলগন্ড দেখা দিতে পারে। এ ক্যান্সার আবার মেয়েদের হবার সম্ভাবনা বেশি। আর যাদের যৌবনের শুরুতে বার বার এক্সরে করতে হয়েছে বা অন্য কোন আনবিক সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের থাইরয়েড ক্যান্সার বেশি হয়। থাইরয়েড ক্যান্সারের হার বরং কম এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে সম্পূর্ণ রূপে সেরে যায়। যে কোন বয়সে থাইরয়েড ক্যান্সার হতে পারে, যদিও চল্লিশ বছরের কাছাকাছি বয়সের বেশি সংখ্যক মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে।
গলগণ্ড হয়েছে বা হচ্ছে মনে হলেও চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত। আমাদের দেশের অনেকেই এ ব্যাপারটাতে বেশ অনীহা প্রকাশ করেন এবং এর জন্য রোগীকে ও তার পরিবারকে শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট ভোগান্তি পোহাতে হয়। গলগন্ডের সম্ভাব্য রোগীকে চিকিৎসক শারীরিক পরীক্ষা রক্ত পরীক্ষায়, আলটাসোনগ্রাম থেকে শুরু করে বায়োপথি ও রেডিও অ্যাকটিভ আয়োডিন আপটেক পরীক্ষা পর্যন্ত করতে পারেন।
গলগন্ডের রোগীর থাইরয়েড গ্রন্থি যদি সামান্য একটু স্ফীত হয়ে থাকে এবং এর শুধুমাত্র পর্যাপ্ত আয়োডিন সরবরাহ করেই এ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিছু যদি আয়োডিনের ঘাটতি জনিত হাইপোথারয়েডের গলগন্ড বৃহদাকার হয়। শুধুমাত্র আয়োডিনের অভাব পূরণ করে তেমন কোন উন্নতি আশা করা যাবে না। এক্ষেত্রে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত থাইরয়েড গ্রন্থিকে অপারেশন করে বাদ দেয়া ছাড়া গত্যান্তর থাকে না। এরই সাথে হরমোন খাওয়াতে হয় আজীবন। আর হাইপার থাইরয়েডিজমের কারণে গলগন্ড হলে থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা কমাতে পারে এমন খাদ্য গ্রহন প্রয়োজন।
গলগন্ড( Goiter disease) রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা-
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসায় প্রাথমিক অবস্থার সকল ধরণের গলগণ্ড সম্পুর্ন ভাল হয়ে যায়। কোন অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে না। ২ থেকে ৩ মাস সময় লাগে।
গরগন্ডের জন্য প্রয়োজনীয় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ সমূহ-
হোমিওপ্যাথি অস্ত্রোপচার ব্যতীত Goiter খুব নিরাপদ এবং কার্যকর চিকিৎসা। Goiter চিকিৎসায় অনেক ঔষধ রয়েছে। গলগন্ড চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথিক ঔষধ নির্বাচনের জন্য রোগীবিস্তারিত তথ্য বিশ্লেষণ করে সঠিক ঔষধ নির্বাচিত হলে সম্পূর্ণ আরোগ্য হয়।
স্পন্জিয়া:
গলগন্ড রোগের উৎকৃষ্ট ঔষধ। গ্ল্যান্ড বড় ও শক্ত।মাঝে মাঝে রোগী ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হইবার উপক্রম হয়। গলগন্ড টিকিৎসায় এই ঔষধটি প্রধানতম।
আইয়োডিয়াম:
আয়োডিনের অভাব জনিত গলগন্ড চিকিৎসায় উত্তম ঔষধ, ভীষন দুর্বলতা, শিরিবেয়ে উপরে উঠিতে হাপিয়ে উঠে উত্তম খুধা প্রচুর পরিমানে খায় তার পরেও দিন দিন শুকিয়ে যায়। সকাল হইতে সন্ধা পর্যন্ত ঢেকুর উঠে এবং সমস্হ খাদ্য বায়ুতে পরিনত হয়। রোগীর যে কোন গ্ল্যান্ড ফুলিয়া গেলে সেখানে বেদনা হীন হলে আয়োডিন উপযোগী। বেদনা বিহীন শক্ত গলগন্ড পীড়া, রোগী অত্যন্ত গরমে কাতর। ঠান্ডা সে ভালোবাসে, ঠান্ডায় সে ভাল থাকে। ক্ষুধা অত্যন্ত, খায় বেশি কিন্তু দিন দিন শরীর শুকাইয়া যায়। এই ধাতুর রোগীর গলগন্ড পীড়ায় ইহা অব্যর্থ।
নেট্রাম মিউর:
গলগন্ডের রোগীর জলীয় লক্ষণ সমুহ বিদ্যমান থাকলে, লবনপ্রীয় রোগীর জন্য উপযোগী। শ্লেষ্মাপ্রধান ধাতুর ব্যক্তি-সামান্য মাত্র ঠান্ডা লাগিলেই সর্দি হয়। উত্তম ক্ষধা ও আহার সত্তেও শরীরের মাংস ক্ষয় হয়। উত্তেজিত ভাব, আদ্বর করিলেও রাগিয়া উঠে সামান্য কারনে চিৎকার করিয়া কাদে। বয়স্কলোকদের সান্তনা দিলে দুঃখবেগ আরো উথলে উঠে। স্নায়ুদুর্বল্য হেতু হাত হইতে দ্রব্যাদি খাসিয়া পড়ে। তিক্তদ্রব্য, লবণ কিংবা লবনাক্ত আহারের ইচ্ছা। উত্তম ক্ষুধা, কিন্তু খাইতে অনিচ্ছা। প্রচন্ড শিরঃপিড়া যেন কেহ মাথায় হাতুড়ি মারিতেছে, বামপার্শগত শিরবেদনা, উহা সুর্যোদয় হতে সুর্যঅস্ত পর্যন্ত বৃদ্ধি। স্ত্রীলোকের ঋতুস্রাবকালিন ও ঋতুস্রাবের পূর্বে বা পরে মাথাব্যাথা। রোগীকে সান্তনা করিলে সে তাহাতে আরো বিরক্ত হয় বা কাদিয়া ফেলে এই সময় বুক আরও ধড়ফর করে এবং নাড়ির গতি সবিরাম হয়, কিন্তু তাহা হৃতপিন্ডের কোন পীড়াজনিত নহে। কোন গলগন্ড রোগীর উপরোক্ত লক্ষণ থাকলে নেট্রাম মিউর উপযোগী।
থাইরয়েডিনাম:
জড় বুদ্ধি, শারীরিক খর্বতা, হৃৎপিন্ডের দুর্বলতা, বুক ধড়ফরানি, দিন দিন শরীর শুকাইয়া যায়। এই ধাতুর রোগীদের নরম তুল তুলে গলগন্ড পীড়ায় ইহা অধিক উপযোগী।
ক্যালকেরিয়া কার্ব:
শ্লেষ্মাপ্রধান স্হুলদেহ, নিদ্রাকালে মাথার ঘামে বালিশ ভিজিয়া যায়। ডিম খাইবার প্রবল ইচ্ছা। ক্যালকেরিয়া কার্ব এর নির্বাচিত লক্ষণ। ভীরুতা ও ভ্রান্ত ধারণা। মাথার ঘামে বালিশ ভিজিয়া যায় ও অল্পেই ঠান্ডা লাগে। ডিম খাইবার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু দুধ সহ্য হয় না। উপরোক্ত গলগন্ডের রোগীরন জন্য ক্যালকেরিয়া কার্ব অপরিহার্য।
গলগন্ডের বাইয়োকেমিক চিকিৎসায় ব্যবহৃত ঔষধ সমুহ–
ক্যালকেরিয়া ফস:
গলগন্ডের জন্য ইহাই প্রধান ঔষধ। রক্তে অম্লরস হৗয়ার জন্য লইম সল্ট ধৌত হয়ে হয়ে যায়। যা পুরণ করতে ক্যালকেরিয়া ফস গুরুত্বপূর্ণ। শরীরে অম্লরস বৃদ্ধি পেলে নেট্রাম ফস পর্যায়ক্রমে ব্যবহার করলে গলগন্ড রোগ আরোগ্য হয়। রক্তহীন রোগীর গলগন্ড হলে ক্যালকেরিয়া ফস উপযোগী। গলগন্ডের মাঝে অন্ডলালা বিদ্যমান থাকলে ক্যালকেরিয়া ফস উপকারী।
কেলিমিউর:
কোষ্ঠবদ্ধ রোগীর জিহ্বা সাদা তাকলে গলগন্ড আরোগ্যে কেলিমিউর উপযোগী।
ক্যালকেরিয়া ফ্লোর:
গলগন্ড পাথরের মত শক্ত হলে ক্যালকেরিয়া ফ্লোর উচ্চশক্তি প্রয়োগ প্রয়োজন।
ম্যাগ ফস:
গলগন্ডের মধ্যে ছাড়ার ন্যায় পদার্থ জন্মে তখন ম্যাগ ফস উপকারী।
নেট্রাম ফস:
গলগন্ড রোগীর জন্য একটি প্রয়োজনীয় ঔষধ। অম্ল প্রধান থাতুর রোগীর জন্য প্রয়োজনীয়।
উপসংহার:
-ডাঃ এলেন বলেন গলগন্ড পীড়ায় গ্ল্যান্ডের কখনও টিংচার-আয়োডিন বাহ্যিক প্রয়োগ করিবেন না, কারণ বাহ্যিক প্রয়োগে একদিকে যেমন গ্ল্যান্ড কমিয়া আসিতে আরাম্ভ হইবে, অন্যদিকে হয়তো তেমনই ফুসফুস আক্রান্ত হইবার সম্ভাবনা হইয়া উঠিবে তাহাতে থাইসিস হইবে।
উপদেশ:
গলগন্ড রোগীর জন্য সমুদ্র তীরে বসবাসের সাথে চিকিৎসা ও আইয়োডিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহন করলে দ্রুত আরোগ্য হয়।
লেখক-ডা.এম.এ.মান্নান
ম্যানেজিং ডিরেক্টর
মুকতাদির হোমিও চিকিৎসা কেন্দ্র
নাগরপুর, টাংগাইল