আফতাবুল কাদের ইকবালপার্বত্যাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের এক অবিস্মরণীয় নাম। ১৯৭১ সালের ২৭ এপ্রিল খাগড়াছড়িরমহালছড়িতেপাকবাহিনীর সাথে এক প্রচণ্ড সম্মুখযুদ্ধে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ইকবাল শহীদ হন। আফতাবুল কাদের জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৭ সালের ২ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে। তবে পৈতৃক গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার (তৎকালীন বৃহত্তর নোয়াখালী) রামগঞ্জ থানার টিওড়া গ্রামে। তার বাবা মরহুম আব্দুল কাদের ছিলেন ইংরেজ আমলের একজন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং মা রওশনআরা বেগম ছিলেন গৃহিণী।
১৯৬৪ সালে ময়মনসিংহ শহরের মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৬ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ইংরেজিতেস্মাতক (সম্মান) এ ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের এই অকুতোভয় বীর সেনা ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ইকবাল ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে আর্টিলারি কোরে কমিশন প্রাপ্ত হন এবং ১৯৭০ সালে হায়দ্রাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড আর্টিলারিরেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দেন। ভালোবাসতেনখালাতো বোন জুলিয়াকে, তিনিও তাঁকে ভালোবাসতেন। তাঁরা বিয়ে করবেন, কিন্তু সেনাবাহিনীর চাকরির কারণে সময় ও সুযোগ করে উঠতে পারছিলেন না। কর্মরত ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দরাবাদের ফিল্ড রেজিমেন্টে। অবশেষে তাঁর সেই সুযোগ হলো ১৯৭১ সালে। ছুটি নিয়ে ঢাকায় আসেন। ১৯ শে ফেব্রুয়ারি বিয়ে হয় তাঁদের। কয়েক দিন পর আনুষ্ঠানিক জীবন শুরু করবেন তাঁরা। কিন্তু তাঁর আগেই জন্মভুমিতে নেমে এলো মানব ইতিহাসের বেদনাদায়ক ২৫ মার্চের কালরাত। সেরাতে পুরনো ঢাকার ফরিদাবাদে ছিলেন তিনি তাঁর পৈতৃক বাড়িতে। একদিকে নববধূঅপরদিকেজন্মভুমি ও মানুষের ডাক। একদিকে জীবন অন্যদিকে মৃত্যু। যুগের এমনই সন্ধিক্ষণে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পাকিস্তানী বর্বরসেনাবাহিনীর বিপক্ষে অস্ত্র তুলে নেবার পথকেই। ২৭ মার্চ ১৯৭১,জন্মভূমির স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিতে শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব, ফরিদাবাদ বাসা থেকে চট্টগ্রামের পথে বেরিয়ে পরেন। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালের ২ মার্চ কালরাত থেকে দিনের পর দিন নিরীহ বাঙালির ওপর পাকবাহিনীর নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যার প্রত্যক্ষ বিবরণ শুনে এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে বদ্ধঘরে স্থির থাকতে পারেনি এই অফিসার।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙারদৃঢ়প্রত্যয়ে ২৮ মার্চ মাকে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা বলে যুদ্ধে অংশ নিতে চট্টগ্রামের পথে বেরিয়ে আসেন এবং শুভপুর যুদ্ধে ইপিআর বাহিনীর সাথে যোগ দেন। ২ এপ্রিল রাতে ক্যাপ্টেন কাদের সীমান্ত শহর রামগড়ে পদার্পণ করে মেজরজিয়ারনেতৃত্বাধীন ১ নম্বর সেক্টরে যোগদান করে শুরু করেন শত্রু মোকাবিলার কর্মব্যস্ততা। রামগড়কে শত্রুমুক্ত রাখার লক্ষ্যে তিনি ইপিআর হাবিলদার কাশেমেরপ্লাটুন ৫ এপ্রিল সফল অপারেশন চালিয়ে ধুমঘাট রেলওয়ের ব্রিজউড়িয়ে দেন। প্রায় পাঁচ শতাধিক সংগ্রামী অস্ত্র ট্রেনিং দেয়ার জন্য জড়ো হন রামগড় সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। এদিকে ১০ এপ্রিল মেজরজিয়া, লে. খালেকুজ্জামানসহ ক্যাপ্টেন কাদের ৫০ জনের একটি গ্রুপের সাথে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রামগড় ত্যাগ করেন। তিনি মহালছড়ি, রাঙ্গামাটি, মানিকছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বিচরণ করে শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ করে ওই এলাকাগুলোকে শত্রুমুক্ত করেন। ২৭ এপ্রিল সকাল নয়টার দিকে মহালছড়িতেঅবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধারা শত্রু আক্রান্ত হয়। পাকিস্তানি ও তাদের সহযোগী মিজোবাহিনীর শত্রুরা ছিল দলে ভারী। তাদের দলে ছিল পাক সৈন্যদের একটি নিয়মিত কমান্ডো কম্পানি, আর ছিল দুই ব্রিগেডে ১৫০০ মিজো সৈন্য। যা মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যার চেয়ে দু’তিন গুণ বেশি। এছাড়া বিমান থেকেও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য ঘাঁটি লক্ষ্য করে একের পর এক বিমান হামলাও চালায় পাকবাহিনী। এক দিকে দু’তিন গুণ বেশি শত্রু সৈন্য, অন্যদিকে পার্বত্য এলাকায় ছিল না কোন পূর্বযুদ্ধ ট্রেনিং।
তবুও অসীম সাহসিকতা নিয়ে বীরযোদ্ধারা লড়াই চালিয়ে যান। এ সময় ক্যাপ্টেন কাদের ছিলেন রাঙ্গামাটিরেকিতে। রেকি শেষে মেজরশওকতেরপ্ল্যান অনুযায়ী ক্যাপ্টেন কাদের যোগ দেন মহালছড়ির এ অসম তুমুল যুদ্ধে। প্রতিকূলতা সত্ত্বেও এ অকুতোভয় তরুণ বীরযোদ্ধার সাহস ও সন্মিলিত প্রতিরোধে মিজোবাহিনী প্রথম অবস্থায় পিছুহটতে শুরু করে। এতে পাক সৈন্যরা পিছন থেকে অস্ত্র ঠেঁকিয়ে তাদের সামনে অগ্রসর হতে বাধ্য করতো। এ অবস্থায় মিজোরা হিংস্র হয়ে উঠে। প্রায় চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের। প্রচণ্ড যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রুদের মেশিনগানের একটি গুলি এসে বিঁধেযুদ্ধরত অসীম সাহসি বীর তরুণ ক্যাপ্টেন কাদের’র বুকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। এসময় সহযোদ্ধা শওকত আলী ও ফজলুর রহমান ফারুক আহত কাদেরকে উদ্ধার করে রামগড়ে নিয়ে আসার পথে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। ২৮ এপ্রিল ভোরে রামগড় কেন্দ্রীয় কবরস্তানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় তাকে। সেদিন নিজের প্রাণের বিনিময়ে প্রায় ২০০ মুক্তিসেনার জীবন বাঁচিয়ে ছিলেন তিনি। এ বীর মুক্তিযোদ্ধার অতুলনীয় বীরত্বকেচিরস্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ সরকার বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করেন তাকে।
#CBALO/আপন ইসলাম