ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ধর্ষণের ঘটনায় এক শিশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষার প্রতিবেদন ও ছাড়পত্রে অসংগতি নিয়ে জেলার চিকিৎসক ও পুলিশের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন হাইকোর্ট।
বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই সমালোচনা করেন। আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. শাহপরান চৌধুরী, রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুল ইসলাম।
পরে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল গণমাধ্যমকে বলেন, আজ আদালতের নির্দেশ মেনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন, পুলিশ সুপারসহ (এসপি) ১১ জন উপস্থিত ছিলেন। তখন আদালত এ ধরনের অসামঞ্জস্য প্রতিবেদনের জন্য পুলিশ বাহিনী ও জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সমালোচনা করেন।
‘আদালত বলেন, সরকারি হাসপাতালের নির্ধারিত ডিউটি বাদ দিয়ে অনেকে চিকিৎসকই ব্যবসা নিয়ে বসে থাকে। আবার অনেকে হাসপাতালে যায় শুধু হাজিরা দিতে। অপরদিকে পুলিশের সমালোচনা করে আদালত বলেন, পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু সেটি প্রমাণিত করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের আরো সতর্ক হতে হবে।’
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ১১ কর্মকর্তাই আদালতকে বলেন, এটি ভুলবশত হয়েছে। এজন্য তাঁরা আদালতে নিশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পরে আদালত, ভবিষ্যতে এসব ক্ষেত্রে আরও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে সবাইকে ব্যক্তিগত জাহিরা থেকেই অব্যাহিত দেন।
এই ১১ জন হলেন- ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিভিল সার্জন ডা. একরাম উল্লাহ, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আনিছুর রহমান, নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ টি এম আরিফুল হক, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মো. একরামুল রেজা, ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা বোর্ডের সদস্য ডা. ফাহমিদা আক্তার, ডা. তোফায়েল হক, ডা. ফরিদা ইয়াসমিন, নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. সৈয়দ মো. শাহরিয়ার, ডা. তাসনিম তামান্না ও ডা. মো. শফিকুল ইসলাম।
গত ১৭ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুর তিনটি মেডিকেল রিপোর্ট ও একটি ছাড়পত্রে অসামঞ্জস্যতার পরিপ্রেক্ষিতে ১১ জনকে তলব করেছিলেন আদালত।
একইসঙ্গে ওই ঘটনায় দুটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন আদালত। এ ছাড়া রুল বিচারাধীন থাকা অবস্থায় এ ঘটনায় নাসিরনগর থানায় দায়ের করা মামলা তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছেন। আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে কোনোরকম হয়রানি করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন আদালত।
আদালত এই মামলায় ভুক্তভোগীর (শিশুর) স্বাস্থ্য পরীক্ষায় কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা গাফিলতি হয়েছে কি না, তা উদঘাটনের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক মাসের মধ্যে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম, অবহেলা বা গাফিলতি হয়েছে কি না, তা উদঘাটনের জন্য পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পুলিশ মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
মামলার বিবরণে জানা যায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে দেওয়া ছাড়পত্রে বলা হয়েছে, ৩ সেপ্টেম্বর শিশুটি ধর্ষণের শিকার হয়। সেখান থেকে দেওয়া আরেক রিপোর্টে বলা হয়, শিশুটির বাহ্যিক কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, সদর হাসপাতালের মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। তাদেরই আরেকটি তথ্য বলছে, জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন হয়েছে।
এজাহার ও নথিপত্র পর্যালোচনা করে আদালত বলেছেন, গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ঘটনার পর ৬ থেকে ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভুক্তভোগী শিশুটি নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। চার সদস্যের চিকিৎসকের মেডিকেল বোর্ডের রিপোর্ট অনুযায়ী, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যৌন নির্যাতন হয়েছে, বিষয়টি প্রশ্নবোধক।
গত বছর ১১ সেপ্টেম্বর নির্যাতিতার বাবা নাসিরনগর থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, ৪ সেপ্টেম্বর সাত বছরের শিশুটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে। মামলায় আসামির বয়স উল্লেখ করা হয় ১৫ বছর।
আদালত-সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ধর্ষণের শিকার শিশুটিকে পরদিন নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। পরবর্তীতে ৮ সেপ্টেম্বর শিশুটিকে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ অবস্থায় এ বিষয়ে ৬ সেপ্টেম্বর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে একটি ডাক্তারি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। অপরদিকে জেলা হাসপাতাল থেকেও একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে আসামি হাইকোর্টে আগাম জামিন আবেদন করে। গত বছরের ৩ নভেম্বর এ আবেদনের ওপর শুনানি হয়। এদিন আসামির বয়স প্রমাণের জন্য তার জন্মসনদ দাখিল করা হয়। জন্মসনদ অনুযায়ী তার বয়স ছিল ১০ বছর। এ অবস্থায় হাইকোর্ট তাকে জামিন দেন এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে এক মাসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি মামলার সিডি এবং তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে তদন্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন।
এরই মধ্যে তদন্ত কর্মকর্তা আসামির বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনের ৯(১) ধারায় অভিযোগপত্র দেন। পরবর্তীতে তদন্ত কর্মকর্তা ও নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হাইকোর্টে প্রতিবেদন দেন। এ সময় জেলা সদর হাসপাতাল থেকে ১২ সেপ্টেম্বরের দেওয়া একটি ডাক্তারি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
দুই প্রতিবেদনে অসংগতি দেখার পর আদালত তদন্ত কর্মকর্তাকে তা নিয়ে প্রশ্ন করেন। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা জেলা সদর হাসপাতালের আরেকটি (গত বছরের ২২ নভেম্বর) প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ অবস্থায় শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আদেশ দিলেন। আদেশে এসপি, নাগিরনগর ওসি ও তদন্ত কর্মকর্তা এবং সিভিল সার্জন ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকসহ ১৩ জনকে তলব করা হয়েছে।
CBALO/আপন ইসলাম