রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:০০ অপরাহ্ন

ই-পেপার

খোকা হতে বঙ্গবন্ধু-বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা ; বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম.আব্দুর রহিম পাকন

প্রতিনিধির নাম:
আপডেট সময়: শনিবার, ৩০ মে, ২০২০, ৯:১০ পূর্বাহ্ণ

১৭ মার্চ মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মদিন। আমরা সমগ্রজাতি প্রতিবছর এই দিনটি যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করে আসছি। এবার ২০২০এ উদ্যাপিত হতে যাচ্ছে জাতির পিতার শততম জন্মবার্ষিকী। প্রতিবছর এই দিনটি যখন আমাদের জীবনে আসে, তখন জাতির পিতার কথা স্মৃতীর পাতায় সকল বাঙ্গালীর হৃদয়ে আন্দোলিত হয়।। শেখ মুজিব ছিলেন টুঙ্গিপাড়ার খোকা। খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু। এরপর জাতির পিতা। সর্বশেষে হয়ে উঠলেন হিমালয়সম  সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী। এ জন্য তাঁর ছবি দেখলে সবাই ব্যাকুল হয়ে থমকে দাঁড়ায়। পৃথিবীতে কতো নেতা এসেছেন, আরও আসবেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মত এমন বিশাল হৃদয়ের অধিকারী মানুষ আর আসবেন বলে মনে হয় না।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বে বঙ্গভূমির শাসন বাঙ্গালী কখনোই করতে পারে নাই। বঙ্গবন্ধুসঠিক নেতৃত্বের কারণেই বাঙ্গালী এবং বাংলা ভাষার পরাধীনতার গ্লানি দূর করে বাঙ্গালির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন সম্ভব হয়েছে। তাই বাঙ্গালীজাতি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতার মর্যাদা দিয়েছে।

 

একজন ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের নেতাকে থানা, থানা থেকে জেলা এবং জেলা থেকে আওয়ামীলীগের নেতাকে জাতীয় নেতার রূপান্তরিত হয়েই তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু হয়েছেন। ফলে সারা বাংলাদেশে আওয়ামীলীগ তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে টিকে আছে। কারো দুঃখ তিঁনি সহ্য করতে পারতেন না। তিঁনি সহজেই সবাইকে আপন করেছেন। যারা বিরোধী ছিলেন, তাঁর ভূবন-ভোলানো আচার-আচরণে তাঁর কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলতেন, “আমি প্রধাণ মন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের অকিার চাই”। বঙ্গবন্ধু ক্ষমতার জন্য কিংবা, ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনীতি করেন নাই। প্রিয় মাতৃভূমিকে পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার হাত থেকে রক্ষা করেবাঙ্গালীরাযেন বাংলাদেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হতে পারে সেজন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতেই তিঁনি রাজনীতি করেছেন।

 

বিশেষভাবে মনে পড়ে ’৭১-এর ৩ জানুয়ারীর কথা। ঐতিহাসিক রেসকোর্স(বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী) ময়দানে ৭০’এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিন বক্তৃতায় তিঁনি বলেছিলেন, ‘৬ দফা ও ১১ দফা আজ আমার নয়, আমার দলেরও নয়। এ-আজ বাংলার জনগণের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। কেউ যদি এর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত সমাধিস্থ করবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও’। জনগণের জন্যই ছিল তাঁর রাজনীতি ও কর্মসূচী। বক্তৃতায় তিঁনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাকে মোনেম খান কাবু করতে পারেনি, এমনকি আইয়ুব খানও পারেনি  কিন্তু আমাকে দূর্বল করে দিয়েছে আপনাদের এই অকুন্ঠ ভালবাসা। আপনারা দোয়া করবেন যেন আপনাদের এই ভালবাসার মর্যাদা দিতে পারি’। বাংলার মানুষের প্রতি ভালবাসার মর্যাদা দিতে তিঁনি একাই রক্ত দেননি সপরিবারে রক্ত দিয়ে সে ঋণ পরিশোধ করে গেছেন।

 

বঙ্গবন্ধুবাংলাদেশকে বাঙ্গালীরআদর্শ রাষ্ট্র রূপে প্রতিষ্ঠার সকল ব্যবস্থা করেছেন। শান্তি ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠাই ছিল তাঁর একমাত্র ব্রত। সকল দুর্ণীতি ও অন্যায় থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার জন্য তিঁনি দেশের মানুষকে আহবান জানিয়েছেন।তাঁর ৭১’এর ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক যে ভাষণ আজ ‘বিশ্ব ঐতিহ্যের প্রামান্য দলিল’ হিসেবে বিশ্ব সভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাঁর এই ভাষণ ছিলমুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণ শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিঁনি পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকলেও তাঁর উপস্থিতি ছিল বাঙ্গালীর হৃদয়ের গভীরে। ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণার প্রারম্ভে তিনি বলেছিলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’। তাঁর এই শেষ বার্তা হৃদয়ে ধারণ করে হাতিয়ার তুলেনিয়েবাঙ্গালীজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা ৯ মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশকে হানাদার মুক্ত করেও বাঙ্গালি স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করতে পারেনি। ১৯৭২ এর ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে মনে হয়েছে,বাঙ্গালীআজ সত্যই স্বাধীন।

 

বঙ্গবন্ধু প্রধাণমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে ১৪ জানুয়ারী দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ১০ এপ্রিল ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’-এর প্রথম অধিবেশনে দেশের জন্য সংবিধান প্রণয়নের ঘোষণা দেন। মাত্র ১১ মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা অর্জন করি সদ্য স্বাধীন দেশের উপযোগী বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান। শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে তিঁনি গড়ে তোলেন। বিশ্বের ১১৬ টি দেশের স্বীকৃতি আদায় করে বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যেদিন লন্ডনে পৌঁছান, সেদিন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকরা তাঁকে বলেছিল, ‘বাংলাদেশ এখন ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়েছে’। তিঁনি বলেছিলেন, ‘এই ধ্বংসস্তুপ থেকেই একদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমিকে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা, ক্ষুধামুক্ত সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করবো’। প্রশাসনিক সংস্কার করে, সামগ্রিক আর্থসামাজিক বিকাশ বেগবান করেএকটি আত্মনির্ভরশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠার জন্য ঠিক যা যা করা দরকার তিন বছর সাত মাস নিরলস পরিশ্রম করে তিঁনি সে সবের ভিত্তি স্থাপন করেন।

 

বঙ্গবন্ধু অন্তরে যা বিশ্বাস করতেন দেশের মানুষকে তা-ই বলতেন।একবার যা অঙ্গীকার করতেন জীবন দিয়ে হলেও তা বাস্তবায়ন করতেন। শুধু দেশের মানুষ নয় বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কগণ বঙ্গবন্ধুকে অপরিসীম শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। তৎকালীন বিশ্ববরেণ্য নেতৃবৃন্দ বিশেষকরে  সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধাণ নিকোলাই পোদগর্নি, প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন, কমিউনিষ্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ইলিচ্ ব্রেজনেভ, যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্র নায়ক মার্শাল জোসেফ ব্রোজ টিটো, ভারতের রাষ্ট্রপ্রধাণ ভিভি গিরি এবং প্রধাণমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট স্মিথ, কানাডার প্রধাণমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো, আলজেরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধাণ হুয়ারে বুমেদিন, তানজানিয়ার রাষ্ট্রপ্রধাণ জুলিয়াস নায়ারে, বৃটেনের প্রধাণমন্ত্রী এডয়ার্ড হিথ, কিউবার রাষ্ট্রপ্রধাণ ফিদেল কাস্ত্রো, মালয়েশিয়ার আব্দুল রাজ্জাক হুসেইন, জাম্বিয়ার রাষ্ট্রপ্রধাণ কেনেথ কাউন্ডা প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুকে অশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। ১৯৭৪ এর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধাণমন্ত্রী, ইংরেজীতে বক্তৃতা করবেন’। কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই’। পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে ৪৫ মিনিট বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধাণ ও প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ বিপুলভাবে করতালি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দিত করেন ।

 

সে এক অভাবনীয় দৃশ্য।অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ বলেছিলেন, ‘সত্যই বাঙ্গালি গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছো, যিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা নন, এশিয়ার নেতা নন, তিঁনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়ত মানুষের অন্যতম নেতা’। তিঁনি নিজের জন্য কিছুই চাইতেন না। অপরের দুঃখ-কষ্টের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁকে সর্বদাই আবেগাপ্লুত করতো। একবার এক জনসভায় তিঁনি বলেছিলেন, ‘একজন মানুষ আর কি চাইতে পারে-আমি যখন ভাবি দূরে এক জনশূন্য পথের ধারে আধো আলো-ছায়ায় এক লোক লন্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে শুধু আমাকে এক নজর দেখবে বলে, তখন মনে হয়, একজন মানুষের পক্ষে আর কি চাওয়া-পাওয়ার থাকতে পারে’। নিরন্ন-হতদরিদ্র-মেহনতী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল প্রগাঢ় ভালবাসা। তা প্রতিফলিত হয়েছে, অভিব্যক্ত হয়েছে তাঁর প্রতিটি কর্মে ও চিন্তায়। ৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর, আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে’।

 

৭৫’এর জানুয়ারীর ১১ তারিখে বাংলাদেশ সামরিক একাডেমিতে প্রথম শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে বিদায়ী ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে এক মর্মস্পর্শী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,‘আমি প্রধাণমন্ত্রী হিসেবে কথা বলছি না, তোমাদের জাতির পিতা হিসেবে আদেশ দিচ্ছি। প্রধাণমন্ত্রী অনেক হবেন, অনেক আসবেন, প্রেসিডেন্টও অনেক হবেন, অনেক আসবেন কিন্তু জাতির পিতা একবারই হন, দু’বার হন না। জাতির পিতা হিসেবেই যে আমি তোমাদের ভালবাসি, তা তোমরা জানো। আমি তোমাদের আবার বলছি, তোমরা সৎ পথে থাকবে, মাতৃভূমিকে ভালবাসবে। মনে রেখ তোমাদের মধ্যে যেন পাকিস্তানী মনোভাব না আসে। তোমরা পাকিস্তানের সৈনিক নও, বাংলাদেশের সৈনিক। তোমরা হবে আমাদের জনগনের বাহিনী’।

 

দীর্ঘ ২৩ বৎসর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্বেরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে জাতির পিতা যে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন সেই চেতনায় স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে তিঁনি ‘জনগণের বাহিনী’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। বক্তৃতায় তিনি বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করে, সেনা সদস্যদের আদর্শবান হওয়ার, সৎ পথে থাকার অঙ্গীকার করে দৃঢ়তার সঙ্গে স্বেহার্দ্র কন্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের জননী কবি কুসুমকুমারী দাশের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করেছিলেন,‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন’।
অতুলনীয় সংগঠক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। দলীয় নেতা-কর্মীদের প্রত্যেককে দেখতেন নিজ পরিবারের সদস্যের মতো। প্রতিটি নেতা-কর্মীর বিপদ-আপদে তিঁনি তাদের পাশে দাঁড়াতেন পরম হিতৈষীর মতো। মমতা মাখানো সাংগঠনিক প্রয়াস নিয়ে কর্মীদের হৃদয় জয় করে নেয়ার ব্যতিক্রমী এক ক্ষমতা ছিল তাঁর। তিঁনি ছিলেন এক জ্যোতির্ময় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর বিনয় মানুষের প্রতি প্রগাড় ভালবাসা, আকাশের মত উদারতা মানুষকে মুগ্ধ করেছে। তেজময় ব্যক্তিত্বের ছটায় মানুষকে সম্মোহিত করার বাউদ্দীপ্ত করার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল মার্জিত, বক্তব্যে ব্যক্তিগত বিষয় প্রাধান্য দিতেন না। অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এক মুহুর্তে মানুষকে আপন করে নেবার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা ছিল তাঁর। নীতির প্রশ্নে ছিলেন অটল।

 

ভুটানের প্রধাণমন্ত্রী রোটে শেরিং একটি মন্তব্য বইতে লেখেন,‘প্রিয় শেখ মুজিব, মানুষ বলে তুমি মৃত, কিন্তু আমি অনুভব করি তুমি আজও আমাদের চারপাশে। আমি খুশীর সঙ্গে জানাতে চাই যে, তোমার ¯^প্ন আজ তোমার মেয়ে শেখ হাসিনার দ্বারা পূরণ হয়েছে। তুমি বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের মন জয় করেছ। তুমি কেবল বঙ্গবন্ধু নও, ভুটানেরও বন্ধু’।

 

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা বঙ্গবন্ধুকে এই অঞ্চলের মহান নেতা আখ্যা দিয়ে বলেন, তাঁর ত্যাগ বাঙ্গালীজাতিকে উজ্জীবিত করে যাবে। এই অঞ্চলে শান্তি ও সমৃদ্ধি অর্জনে বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য পূরণের অংশীদার হতে পেরে শ্রীলঙ্গা গর্বিত। শ্রীলঙ্গার সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা লিখেছেন গভীর মর্মস্পর্শী কথা,‘এমন একজন মহৎ মানুষকে নিছক বুলেটবিদ্ধ করে হত্যা করা হলো। তবে তাঁর অর্জনের স্মৃতী এ দেশে বেঁচে থাকবে। তাঁর অনুসারী এবং কন্যা যেন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উচ্চতায় বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে সক্ষম হন, এমন প্রত্যাশা ব্যাক্ত করেছেন চন্দ্রিকা।
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক কুলদীপ নায়ার তার ‘ডিসট্যান্ট নেইবার’ বইয়ে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবর রহমানের দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ও অমোঘ ব্যক্তিত্ব তাঁকে শুধু বাংলারই একজন শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে সাহায্য করেছে তা নয়, তাঁর মানবতাবোধ, বিশাল অন্তঃকরণ তাকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতেও ভূষিত করেছে’। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধু নিজেকে বিশ্বের একজন সেরা রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর ব্যক্তিগত গুনের মহিমায় তিঁনি বাংলার আপামর জনগনের নয়নমণি হতে পেরেছিলেন ও লাভ করেছিলেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি।
নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ম্যালকম এম ব্রাউনের মতে, ‘বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে সারাদেশ উঠতো আর বসতো। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো তর্জনী এত কার্যকর হয়নি’। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু আবির্ভাব শুধু বাঙ্গালি জাতির জন্য নয় বরং উপমহাদেশের জন্যই ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ’। বঙ্গবন্ধুকে তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

 

র্কিন সাংবাদিক ও সাহিত্যিক অ্যানি লোপা তার স্মৃতীচারণে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ঘরোয়া পরিবেশে। একবারও মনে হয়নি এত বড় একজন নেতার সামনে বসে আছি। বন্ধুসুলভ মুজিব নিজে চায়ের কাপ তুলে দিলেন আমার হাতে। এমন অসাধারণ মনের পরিচয় পাওয়া কঠিন। আমার সাংবাদিক জীবনে পৃথিবীর নানা দেশ ঘুরেছি, বহু নেতা-নেত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেছি, কিন্তু বাংলাদেশের শেখ মুজিবের মতো এমন সহজ-সরল মানুষ আর পাইনি’।

 

বঙ্গবন্ধুর সাথে সুসম্পর্ক ছিল তখনকার কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ত্রোর। ১৯৭৫-এর শোক প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবের মৃত্যুতে সারা বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো তাদের একজন মহান নেতাকে, আর আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে’।তাঁর আরেক বিখ্যাত উক্তি তো মানুষের মুখে মুখে ফেরে  ‘আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি’। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী বলেছিলেন, ‘টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিবের কবর একদিন সমাধিস্থলে রূপান্তরিত হবে এবং বাঙ্গালীরতীর্থস্থানের মতো রূপলাভ করবে’। সময় যত পার হচ্ছে এই কথার সত্যতা তত বেশী করেমিলছে।

 

হুমায়ুন আজাদ তার লেখাতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে লিখেছেন,‘ শেখ মুজিব দৈহিকভাবেই মহাকায় ছিলেন, সাধারণ বাঙ্গালীরথেকে অনেক উচুঁতে ছিলো তাঁর মাথাটি, সহজেই চোখ পড়তো তার উচ্চতা। একাত্তরে বাংলাদেশকে তিনিই আলোড়িত-বিস্ফোরিত করে চলেছিলেন, আর তার পাশে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছিল তাঁর সমকালীন এবং প্রাক্তন সকল বঙ্গীয় রাজনীতিবিদ। জনগণকে ভুল পথেও নিয়ে যাওয়া যায়। হিটলার-মুসোলিনির মতো একনায়কেরাও জনগণকে দাবানলে, প্লাবনে, অগ্নিগিরিতে পরিণত করেছিলো। একাত্তরের মার্চে শেখ মুজিব সৃষ্টি করেছিলো শুভ দাবানল, শুভপ্লাবন, শুভ অগ্নিগিরি, নতুনভাবে সৃষ্টি করেছিলেন বাঙ্গালীমুসলমানকে, যার ফলে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম’।

 

বঙ্গবন্ধু সাধারণ, সহজ-সরল জীবন কাটাতেই ভালোবাসতেন। নবগঠিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধাণ হয়েও তিনি তাঁর সরকারী বাসভবনের পরিবর্তে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সাধারণ বাড়িতেই থাকতেন।শেষে আমাদের একটা কথা বিশেষভাবে মনে রাখতে হবে, ‘মৃত্যুতে হয় না শেষ কোন কোন প্রখর জীবন’। বঙ্গবন্ধু মৃত্যুঞ্জয়ী, তিঁনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের হৃদয়ে, পথ দেখাবেন বাতিঘর হয়ে। শোক নয়, নতুন শপথের সময় এখন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শক্তিতে বলিয়ান হয়েই এগিয়ে যেতে হবে জাতিকে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সেটাই হবে আমাদের যথার্থ শ্রদ্ধাঞ্জলি। জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু।

উপদেষ্টা,বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ,পাবনা জেলা শাখা
নির্বাহী সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর