ড. সত্য প্রসাদ মজুমদারঃ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০০ বছর আগে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
এই স্বনামধন্য বঙ্গসন্তানের পিতার নাম শেখ লুৎফর রহমান। তিনি গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল থেকে শিক্ষাজীবন শুরু করেন।
১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক ও ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৪৭ সালে একই কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। স্কুলজীবন থেকেই জাতির পিতার মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল।
১৯৪৬ সালে তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৪৩ সাল থেকে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর একজন ঘনিষ্ঠ অনুসারী।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ গঠনে প্রধান সংগঠকদের একজন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৪৯ সালে তিনি জেলে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক পদে নির্বাচিত হয়ে তার সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তরুণদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন। তারুণ্যের স্বপ্ন ও প্রত্যাশাকে তিনি নিজের চিন্তায় ধারণ করতেন।
তরুণ রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করার তার যে ক্ষমতা ছিল, তা তিনি ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে প্রদর্শন করেছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ওই পদে বহাল থাকেন।
এই আওয়ামী মুসলিম লীগই পরবর্তী সময়ে পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নামে রূপান্তরিত হয়। ১৯৬৬ সালেই তিনি দলের সভাপতি হন।
১৯৫৮ সালে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হয় এবং বাঙালিদের ওপর দমনপীড়ন শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু তখন এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য তরুণদের সংগঠিত করেন।
পাকিস্তানি দুঃশাসন ও বৈষম্যমূলক নীতির শিকার সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ে বাঙালিদের প্রতি যে অমানবিক শাসন-শোষণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে, তা থেকে জাতিকে মুক্তির লক্ষ্যে প্রণীত হয়েছিল ঐতিহাসিক ৬ দফা।
পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হয়েছে, ৬ দফাই ছিল পূর্ববাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান সোপান। ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলনের জোয়ারে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনের ফলাফল গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে। পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী স্বভাবতই ’৭০-এর নির্বাচনে হার মেনে নিতে পারেনি।
পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২ মার্চ থেকে প্রতিদিন হরতাল চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। তিনি বহু দলে বিভক্ত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণে। তার উদাত্ত আহবান জাদুকরী প্রভাব ফেলেছিল এ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সবার হৃদয়ে।
এই ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাহস, দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণাবলি সুন্দরভাবে প্রকাশ পায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবেই আমাদের কাছে রক্ষিত আছে এবং থাকবে।
সবাই জানেন, ১৫ আগস্ট ছিল বাংলার জনমানুষের অবিসংবাদিত নেতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৫তম শাহাদতবার্ষিকী এবং জাতীয় শোক দিবস।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট অপশক্তির চক্রান্তে কিছুসংখ্যক বিপথগামী সামরিক অফিসারের হাতে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনে সপরিবারে শহীদ হন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার এবং তার পরিবারসহ ১৫ আগস্টে যারা শাহাদতবরণ করেছেন তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং তাদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি, যখন তিনি চাঁদপুরে জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। তার গাড়িবহরের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। ওইদিন আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই তাকে এক পলক দেখার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাস্তায় ও জনসভায় অপেক্ষা করেছিলেন। তাকে দেখে তাদের জীবনকে ধন্য করেছিলেন।
বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আছে জননন্দিত মহামানব বঙ্গবন্ধুর নাম। তার আপসহীন সংগ্রাম, নিরলস সাধনা, অসীম সাহস ও উদ্দীপনা, দেশমাতার জন্য অফুরন্ত ত্যাগ ও ভালোবাসা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তাই বাঙালির আত্মপরিচয়ের আরেক নাম শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধিকার চেতনা থেকে স্বাধীনতায় উত্তরণ, সর্বোপরি একটি দেশের জন্মের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বঙ্গবন্ধুর অম্লান স্মৃতি। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের পর থেকে ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তানের তেইশ বছরের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস।
দীর্ঘ এ সংগ্রাম শেষে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শুরু করেন আরেকটি যুদ্ধ। এই যুদ্ধ সমৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি ও উন্নতির। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও ক্ষতবিক্ষত অবস্থা থেকে দেশকে গড়ে তোলার প্রাথমিক কাজ সম্পাদন করে বঙ্গবন্ধু সূচনা করেছিলেন তার ‘অর্থনৈতিক মুক্তি’ অর্জনের সংগ্রাম।
যুগে যুগে বিভিন্ন দেশে অনেক বরেণ্য নেতা জন্ম নিয়েছেন। তারা সবাই নেতৃত্বের নানা গুণে গুণান্বিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হৃদয়বান ও মানবিক নেতৃত্ব খুবই বিরল। তিনি মানুষের প্রতি ভালোবাসাকে সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন, আর তার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ছিল দেশ ও মানবপ্রেম। মানবকল্যাণে উৎসর্গকৃত বঙ্গবন্ধু চিরদিন মানুষের হৃদয়েই চিরজীবী হয়ে থাকবেন।
বঙ্গবন্ধু শুধু তার জনগণের রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্যই সংগ্রাম করেননি- তিনি জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। সেই মুক্তি অর্জনের সংগ্রাম এক অবিরাম প্রচেষ্টায় এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নিঃসন্দেহে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্নগুলো পূরণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক মূল্যবান অবদান ইতোমধ্যে রেখেছেন এবং রেখে চলেছেন। তারই নেতৃত্বে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি।
বিদ্যুতের প্রকট সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। এর ফলে আজ দেশে প্রয়োজনের অধিক পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে এবং ভবিষ্যতের চাহিদার কথা ভেবে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং আমদানি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের কাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। রাস্তাঘাট, সেতু-কালভার্ট নির্মাণের নতুন প্রকল্প একের পর এক বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায় মেট্রোরেল, উড়াল সড়ক, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, নদীর নিচ দিয়ে টানেলসহ বিভিন্ন দিকে উন্নয়নের যে জোরালো কার্যক্রম তিনি সফলতার সঙ্গে পরিচালনা করছেন, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো অন্যতম বৃহৎ প্রকল্পটি সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একাগ্রতা, দৃঢ়তা ও প্রচেষ্টা একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
তার নেতৃত্বে সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ কক্ষপথে প্রেরণ ও স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ আজ স্যাটেলাইট যুগে প্রবেশ করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। উন্নয়নের গোটা তালিকাটি আরও অনেক বড়। তবে সব উন্নয়নের তাগিদ, উৎসাহ, উদ্যোগ, কার্য সম্পাদনের প্রেরণা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশে আজ উন্নয়নের সুবাতাস বইছে।
এরই ধারাবাহিকতায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, দেশকে কৃষি ও শিল্পে সমৃদ্ধ করে তোলা এবং বাঙালির জাতীয় সংস্কৃতি ও স্বাধীন সত্তার উৎকর্ষ সাধন ও বিকাশ ঘটানোর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বকে সজীব করে রেখেছেন এই চিরসবুজ বাংলাদেশে।
আশা করি, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকবে। এ ক্ষেত্রে তার উৎসাহের মূলে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও আদর্শ। আজ দেশের এই উন্নয়ন, সাফল্য ও অগ্রযাত্রার সময় স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
এ পর্যায়ে আবারও জাতির জনক এবং তার পরিবারের নিহত সদস্যসহ সবার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। একই সঙ্গে আজকের এই দিনে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দীর্ঘায়ু ও সুস্বাস্থ্য কমনা করছি।
বুয়েট সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধুরই স্বপ্নপ্রসূত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বুয়েট আরও এগিয়ে যাবে।
অধ্যাপক ড. সত্য প্রসাদ মজুমদার : উপাচার্য, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)
(আগামীকাল প্রকাশিত হবে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এম রোস্তম আলীর লেখা)