শনিবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৭:০২ অপরাহ্ন

ই-পেপার

ভাঙ্গুড়ায় ইউএনও নাজমুন নাহারের স্বেচ্ছাচারিতা ও কোটি টাকার অনিয়ম: রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় অদৃশ্য প্রভাব

চলনবিলের আলো ডেস্ক:
আপডেট সময়: শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৪:৪৯ অপরাহ্ণ
ছবি: পাবনার ভাঙ্গুড়ার ইউএনওর বিরুদ্ধে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের অভিযোগ।
ছবি: পাবনার ভাঙ্গুড়ার ইউএনওর বিরুদ্ধে অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের অভিযোগ।

পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা: নাজমুন নাহারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক পক্ষপাত, কোটি টাকার প্রকল্প দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা ও বিতর্কিত কর্মকান্ডের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা হারিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন এবং এই প্রভাব ব্যবহার করে অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন। এই অভিযোগগুলো কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ী, সামাজিক সংগঠন ও সচেতন মহলেও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা এ ধরনের কর্মকান্ড প্রশাসনের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল নাজমুন নাহার ভাঙ্গুড়ায় ইউএনও হিসেবে যোগ দেন। যোগদানের পর থেকেই তিনি তৎকালীন পাবনা-৩ আসনের সাবেক সাংসদ মকবুল হোসেনে ও তার ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান গোলাম হাসনাইন রাসেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এই সম্পর্কের ফলে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকে। বিভিন্ন প্রকল্প অনুমোদন, সরকারি তহবিল বরাদ্দ ও সরকারি সুবিধা বণ্টনে দলীয় পক্ষপাতের অভিযোগ ওঠে। অনেক সরকারি সেবা প্রাপকের অভিযোগ প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমও রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাবিত হয়েছে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলালেও নাজমুন নাহারের আচরণে তেমন পরিবর্তন আসেনি। অভিযোগ রয়েছে, তিনি এখনও সাবেক ক্ষমতাসীনদের প্রশাসনিক আশ্রয় দেন। একই বছরের ১৩ অক্টোবর দুর্গাপূজার প্রতিমা বিসর্জনের সময় প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ স্থানে সাবেক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক,পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ও বর্তমান জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. বাকি বিল্লার পাশে বসে অনুষ্ঠান পর্যবেক্ষণ করেন। এমনই বেশ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনা আরও তীব্র হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন নিরপেক্ষ প্রশাসন কেমন করে রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে এভাবে প্রকাশ্যে অবস্থান নেয়?
রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নাজমুন নাহার বিএনপি নেতাদের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২৫ সালের ২৫ এপ্রিল জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় খবর প্রকাশ হয় ভাঙ্গুড়ায় ৫৫টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন না করেই এক কোটি ৭০ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। অভিযোগের কেন্দ্রে প্রকল্পটির সভাপতি ইউএনও নাজমুন নাহার। সংবাদ প্রকাশের পর তিনি প্রথমে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে সাংবাদিকদের হুমকি দেন, পরে কয়েকজন নামধারী সাংবাদিককে ম্যানেজ করে নিজের পক্ষে প্রতিবেদন করান। ওই প্রতিবেদন তিনি উপজেলা প্রশাসনের সরকারি ফেসবুক পেজে প্রকাশ করেন, যা সমালোচনা আরও বাড়ায়।

এছাড়ার তিনি মূল ধারার সাংবাদিকদের ম্যানেজর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে চলতি বছরের ৩০ এপ্রিল উপজেলা আইন শৃঙ্খলা মাসিক মিটিংয়ে উপস্থিত সকলের সামনে তার বক্তব্যে বলেন, আমার বিরুদ্ধে কিছু সাংবাদিক দুর্নীতি ও অনিয়মের নিউজ প্রকাশ করছে। আপনারা যারা বিএনপির নেতা আছেন আমাকে সহযোগিতা করুন এবং এই সকল সাংবাদিকদের প্রতিরোধ করুন। একই ঘটনা ঘটে ২০২৫ সালের ১৩ জুলাই। ‘প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম’ শিরোনামে খবর প্রকাশ হলে তিনি একই কৌশল ব্যবহার করেন।

স্থানীয় রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ভাষ্য, এটি প্রশাসনিক অবস্থান ধরে রাখার একটি কৌশল। বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের কয়েকজন নেতার মাধ্যমে তিনি সাংবাদিকদের চাপ দেন এবং নিজের অনুকূলে বিভিন্ন সময় সংবাদ প্রকাশ করান।

এছাড়াও অভিযোগ রয়েছে, উপজেলার অষ্টমনিষা ইউনিয়ন পরিষদের ভূমি অফিসের অফিস সহায়কের ঘুষ গ্রহণের সময় ছাত্র-জনতা তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। পরবর্তীতে ভুক্তভোগীরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দিলেও নাজমুন নাহার অনৈতিক সুবিধা নিয়ে ওই অফিস সহায়ককে ক্ষমা করে দেন। এই ঘটনায় প্রশাসনিক শৃঙ্খলা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা আরও কমে যায়।

সম্প্রতি বহুল আলোচিত কৈডাঙ্গা গ্রামের শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও হত্যা মামলার প্রধান আসামি নিরব খানকে ফুটবল উপহার দেন ইউএনও। এই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে এলাকাজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা কিভাবে এ ধরনের বিতর্কিত ব্যক্তিকে এভাবে পুরস্কৃত করেন?

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, জিআর-টিআর ও কাবিখা-কাবিটা প্রকল্প থেকে নাজমুন নাহার ১০ শতাংশ কমিশন নেন। যদিও এটি প্রকাশ্যে প্রমাণিত নয়, এলাকায় এটি ‘টপ সিক্রেট’ হিসেবে পরিচিত। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না।

স্থানীয়দের মতে, সরকারি প্রশাসনের প্রতি আস্থা নষ্ট হচ্ছে এ ধরনের কর্মকান্ডে। অনেকে মনে করেন, দীর্ঘদিন ধরে চলা অনিয়ম-দুর্নীতির পেছনে রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রই মূল কারণ। প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের জন্য অনেকে উচ্চ পর্যায়ে স্বাধীন তদন্ত দাবি করেছেন।

তবে এ বিষয়ে উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব জাফর ইকবাল হিরো বলেন, গণমাধ্যম কর্মী সমাজের দর্পণ। তারা অনিয়ম-দুরননীতি নিউজ করবেই। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রশ্রয় দেয় না।

ভাঙ্গুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোছা: নাজমুন নাহারের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি কোন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় প্রকল্প বন্টন করেনি এবং কোন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দুর সহযোগিতা চাইনি। আইন-শৃঙ্খলা মাসিক মিটিংয়ে প্রকল্পের অনিয়মেরব বিষয়টা বিএনপির নেতারাই উত্তোলন করেছে আমি তাদের কথার শুধু উত্তর দিয়েছি।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর