শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ০২:৩৫ অপরাহ্ন

ই-পেপার

ওসিকে ঘটনা সাজানোর পরামর্শ দেন এসপি!

প্রতিনিধির নাম:
আপডেট সময়: শনিবার, ৮ আগস্ট, ২০২০, ৫:৪৫ অপরাহ্ণ

কক্সবাজারের টেকনাফ থানার বাহারছড়ায় পুলিশের চেকপোস্টে সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশে মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে গুলি করে হত্যার পর তাঁরই পরিকল্পনায় গোলাগুলি, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধারের মামলা সাজানো হয়। ওসি প্রদীপের কথামতো জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) এ বি এম মাসুদ হোসেন ঘটনাটি সাজানোর পরামর্শ দেন। দেশব্যাপী চাঞ্চল্য তৈরি করা এ ঘটনার পর এসপির সঙ্গে ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত আলীর ফোনালাপের একটি অডিও প্রকাশ পেয়েছে। এতে দুজনের কথার সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। তিনজনের কথায় অস্ত্রের কথা বলা হলেও মাদক উদ্ধারের ব্যাপারে কোনো তথ্যই ছিল না।

অডিওতে শোনা যাচ্ছে, ওসি প্রদীপ এসপি মাসুদকে বলেন, সিনহা রাশেদ গুলি করায় তাঁর নির্দেশে লিয়াকত গুলি করেন। তবে লিয়াকত এসপিকে বলেন, সিনহা রাশেদ গুলি তাক করেছিলেন। এসপি মাসুদ তখন ওসি প্রদীপের সুরে লিয়াকতকে বলেন, ‘তোমারে গুলি করছে, তোমার গায়ে লাগেনি, তুমি যেটা করছ সেটা তার গায়ে লাগছে!’ এর মাধ্যমে ওসির সাজানো মামলায় এসপি সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মেজর সিনহা নিহত হওয়ার ঘটনায় তদন্ত কমিটির রিপোর্টে কক্সবাজারের এসপির বিরুদ্ধে কোনো বিষয় থাকলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়ে সাক্ষী বানানো হয়েছে পুলিশের সেই সাজানো মামলায়। কালের কণ্ঠ’র কাছে মামলার তিন সাক্ষী এমনই দাবি করেছেন। অন্যদিকে স্থানীয় লোকজন বলছে, ওসি প্রদীপ থানায় এবং থানার বাইরে দুটি সিন্ডিকেট তৈরি করে ক্রসফায়ার ও সমঝোতার নামে টাকা আদায়ের কারবার করেছেন। ওসি প্রদীপ গ্রেপ্তার হলেও তাঁর এসব সহযোগী এখনো সক্রিয় আছেন।

গতকাল সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডির বাসভবনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, সিনহা রাশেদ নিহতের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের পরই এ মামলার জট খুলে যাবে। প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘তদন্তে কক্সবাজারের এসপির বিষয়ে কিছু পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এদিকে অভিযোগের ব্যাপারে জানার জন্য গতকাল কয়েকবার ফোন করলেও এসপি এ বি এম মাসুদ হোসেন ধরেননি। এর আগে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ঘটনায় তাঁর কোনো দায় নেই। যেভাবে জেনেছেন সেভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছেন।

ফোনালাপে ঘটনা সাজানোর আলামত 
রাত ৯টা ২৫ মিনিট থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটে গুলির ঘটনা। এর পরই ওসিকে ফোন দেন লিয়াকত। রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে এসপি এ বি এম মাসুদ হোসেনকে ফোন দেন ওসি প্রদীপ। তখন ওসি বলেন, ‘স্যার, লিয়াকত নাকি গুলি করেছে, আমি যাচ্ছি সেখানে। এই যে স্যার, লিয়াকত চেকপোস্টে একটি গাড়িকে সিগন্যাল দিছে। গাড়ি থেকে তাকে পিস্তল দিয়ে গুলি করছে। আমি বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি ওকে গুলি করো। সে-ও নাকি গুলি করছে স্যার। আমি যাচ্ছি ওখানে স্যার।’ তখন এসপি মাসুদ বলেন, ‘যান যান।’ এর পরই রাত ৯টা ৩৪ মিনিটে লিয়াকতও এসপিকে ফোন করেন। লিয়াকত বলেন, ‘স্যার, এখানে একটা প্রাইভেট কার ঢাকা মেট্রো লেখা। আর্মির পোশাকটোশাক পরা। সে ওই বোরকা খুলে ফেলছে। পরে তাকে যখন চার্জ করছি, মেজর পরিচয় দিয়ে গাড়িতে চলে যেতে চাইছিল। পরে অস্ত্র তাক করেছিল, আমি গুলি করছি স্যার। একজন ডাউন করছি, আরেকজন ধরে ফেলছি স্যার। আমি কী করব স্যার? আমাকে পিস্তল তাক করছে? পিস্তল পাইছি তো স্যার।’ পরিদর্শক লিয়াকতের এই বক্তব্যের পর পর এসপি মাসুদ বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোমারে গুলি করছে, তোমার গায়ে লাগেনি, তুমি যেটা করছ সেটা তার গায়ে লাগছে।’ তখন লিয়াকত বলেন, ‘রাইট স্যার।’

পুলিশ আটক করার পর সিফাত যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানেও দুই পক্ষের অস্ত্র তাক করার তথ্য নেই। প্রকাশ পাওয়া সিফাতের একটি জবানবন্দিতে দেখা গেছে, তিনি বলেছেন, পথ আটকানোর কারণে সিনহা রাশেদ রেগে যান। তবে তিনি অস্ত্র নিয়ে গুলি করা তো দূরের কথা গুলি তাকও করেননি। সিফাত বলেন, ‘লিয়াকত সাহেবের সঙ্গে ডিবির দুই লোক ছিল। বাকিরা ইউনিফর্মে। পুলিশ রাগারাগি করে সিনহা ভাইকে গুলি করে। তখন আমরা সামনের দিকে যাচ্ছিলাম।’

থানায় ডেকে সাদা কাগজে সই নিয়ে সাক্ষী  
মারিশবুনিয়া কমিউনিটি পুলিশের সদস্য নূরুল আমিনকে (২১) পুলিশের মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়। এজাহারে বলা হয়েছে, মোবাইল ফোনে পাহাড়ে কয়েকজন ডাকাত ছোট ছোট মোবাইল ফোন নিয়ে ঘুরছিল বলে জানায়। পরে ঘটনাস্থলে নূরুল আমিন, তাঁর প্রতিবেশী হামিদ হোসেন (২৪) ও আইয়াসের (৪০) সামনে সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে আটক এবং গাড়ি থেকে অস্ত্র-মাদক উদ্ধার করা হয়। বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া গ্রামের নাজিমউদ্দিনের ছেলে নূরুল অমিন এখন বলছেন, তিনি ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন না। পরে তাঁকে বাহারছড়া তদন্তকেন্দ্রে ডেকে নেওয়া হয়। আরেক সাক্ষী আইয়াস উদ্দিন বলেন, তিনি ঘটনার কিছুই দেখেননি। রাতে তদন্তকেন্দ্রে নেওয়ার পরদিন সকালে টেকনাফ থানায় নিয়ে তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয়। তিনি বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছায় সাক্ষ্য দিইনি। আমার কাছ থেকে পুলিশ কয়েকটি সাদা কাগজে সই নিছে।’

ওসি প্রদীপের দুই সিন্ডিকেট
স্থানীয় কয়েকটি সূত্র জানায়, ইয়াবার তকমা দিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায় করতে ও দুর্বলদের ক্রসফায়ার দিতে থানায় নিজের ঘনিষ্ঠ একটি সিন্ডিকেট এবং স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাবশালীদের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেন প্রদীপ। তার জন্য দেনদরবার করতেন টেকনাফের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী। তাঁদের মধ্যে রয়েছে টেকনাফ পৌরসভার বাসিন্দা ও সাবেক এমপি আব্দুর বদির ফুফা হায়দার আলী, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান আবু সৈয়দ এবং পৌর এলাকার জুয়েলারি ব্যবসায়ী সজল। তাঁরা তিনজনই সাবেক এমপি বদির আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠজন। কোনো ব্যক্তিকে আটক করলে ওই তিন ব্যক্তির যেকোনো একজন যোগাযোগ করতেন আটক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে। তাঁরা মোটা অঙ্কের টাকার লেনদেন করে আটক ব্যক্তিকে পাঠানো হতো জেলে। তাঁরা বড় বড় ইয়াবা কারবারিকেও টাকার বিনিময়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে নিতেন। এঁদের মধ্যে হায়দার আলীর এক ছেলে প্রথম দফায় আত্মসমর্পণ করেছেন। বদির ব্যাবসায়িক অংশীদার আবু সৈয়দ ও তাঁর ছেলে মোহাম্মদ আব্দুল্লাহর বিরুদ্ধেও রয়েছে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ। জানতে চাইলে গতকাল অভিযোগ অস্বীকার করে আবু সৈয়দ বলেন, ‘ভালো লোকজন ধরলে আমি যাইতাম। তবে কোনো কারবার করি নাই।’

পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, থানায় ওসি প্রদীপের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বহাল আছেন এএসআই ফকরুল জামান, এসআই জামসেদ, এসআই সুজিত, কনস্টেবল নাজমুল (ওসির বডিগার্ড), এসআই মশিউর রহমান, এএসআই আমির হোসেন, এএসআই মিসকাত উদ্দিন, কনস্টেবল রুবেল দাশ (‘ক্রসফায়ারে’ সবচেয়ে বেশি গুলি ছুড়েছেন), কনস্টেবল মো. মহিউদ্দিন খান, কনস্টেবল আবদুল আজিজ, এসআই দীপক বিশ্বাস, এএসআই সঞ্জিব দত্ত, কনস্টেবল বাহার উদ্দিন, এএসআই মিঠুন চক্রবর্তী (ওসি প্রদীপের ভাগ্নে), কনস্টেবল সাগর দেব, এএসআই কাজী সাইফ মাহমুদ এবং টেকনাফ পৌর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুল হোসাইন। তাঁরা ক্রসফায়ারের নামে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য করেছেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। টেকনাফের ডেইলপাড়ার বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, ‘ওসি প্রদীপের সহযোগীরা নিরপরাধ লোকদের মাদক কারবারি বানিয়েছে। তারা অভিযানে গেলে সঙ্গে থাকত একটি করে নোয়া গাড়ি। এসব গাড়ি নিয়ে তারা টেকনাফের আনাচকানাচ চষে বেড়াত এবং লোকজনকে আটক করে রাতে থানায় নিয়ে যেত। কেউ দাবি করা টাকা না দিলে তার ভাগ্যে জুটত বুলেট।’


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com
Raytahost Facebook Sharing Powered By : Raytahost.com