মৃত্যু একটি সুমধুর বিষাদ ; মৃত্যুই কি জীবনের শেষ কথা ? নাট্যকার, নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা এবং সংগীতশিল্পী মাসুম আজিজ হাসপাতালের বিছানায় শেষ দিনগুলোতে স্বজনদের সঙ্গে আলাপচারিতায় মাঝে মধ্যে এরকম অনেক কথা বলেছেন তিনি। আজ ১৭ অক্টোবর তার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। দিবসটি পালনে পাবনার ফরিদপুর পরিবারের পক্ষ থেকে স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। এ ছাড়া তার কবর সংরক্ষণের ভিত্তি স্থাপন করা হবে। ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুসহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ উপস্থিত থাকবেন। এ ছড়া ২২ অক্টোবর জন্মদিনে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে পদাতিকের আয়োজনে মাসুম আজিজ রচিত নাটক, গান পেিরবশন করা হবে। নাট্য ব্যাক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, গোলাম কুদ্দুস, শামসুজ্জামান হীরা, সাবিহা জামানসহ মঞ্চ শিল্পীরা উপস্থিত থাকবেন।
মাসুম আজিজ, একজন নাট্যকার, নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা এবং সংগীতশিল্পী। তিনি মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে সাম্য সমৃদ্ধ শোষণ বঞ্চনামুক্ত সমাজের জন্য লড়াইয়ের আকুতোভয় শিল্পযোদ্ধা ছিলেন। আমৃত্যু সৃজন সংগ্রামী এই মানুষটি জন্মগ্রহণ করেন ২২অক্টোবর ১৯৫৩ সালে। পিতা আবু ইউসুফ মো: আখতারুজ্জামান, মাতা আজিজা সুলতানা। দশ ভাই বোনের মাঝে তিনি ছিলেন সপ্তম।
পিতার পুলিশের চাকুরির কারনে দেশের নানা অঞ্চলে নানা মানুষের মধ্যে বসবাসের মাধ্যমে বেড়ে ওঠেন মাসুম আজিজ। পৈতৃক ঠিকানা পাবনার বনওয়ারী নগর হলেও তিনি জন্মগ্রহণ করেন হবিগঞ্জ জেলায়। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুল থেকে প্রাথমিক শেষ করে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন রংপুর জিলা স্কুলে। ১৯৬৭ সালে রংপুর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ভর্তি হন রংপুর কারমাইকেল কলেজে। এর মাঝে বাবার চাকুরির বদলির কারণে চলে আসেন পাবনা। পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এইচএসসি পাশ করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি অনার্সসহ মাস্টার ডিগ্রী অর্জন করেন।
ছোটবেলা থেকেই মাসুম আজিজ গান, অভিনয় আর বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের বার্ষিক নাটকে প্রক্সি রিহার্সাল করতে গিয়ে সে চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। একই হলে পরের বছরে জ্বালা নাটকের নির্দেশনা দিয়ে শ্রেষ্ঠ নির্দেশক এর পুরস্কার লাভ করেন। এই দুটি ঘটনা সংগীত শিল্পী মাসুম আজিজকে নাটকে স্থায়ী হবার স্বপ্ন দেখায়। ১৯৭৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চে করেন ‘সোহরাব রোস্তম পালা’। এরপর থেকেই তিনি নিয়মিত গ্রæপ থিয়েটার এ যাতায়াত শুরু করেন।১৯৮১ শালে তিনি যুক্ত হন ঢাকা পদাতিক এর সাথে। এখানে তিনি সৈয়দ জামিল আহমেদ এর সান্নিধ্যে আসেন। সৈয়দ জামিল আহমেদ এর নির্দেশনায় ইন্সপেক্টর জেনারেল নাটকের ডিসি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমেই মাসুম আজিজের ঢাকায় নাট্যযাত্রা শুরু। আমৃত্যু তিনি ঢাকা পদাতিক এর সক্রিয় সদস্য ছিলেন। থিয়েটার এর এই যাত্রার মাঝেই পরিচয় হয় তার নাট্যগুরু মামুনুর রাশীদ এর সাথে। শহরের জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত হয়ে যখন ফিরে যাচ্ছিলেন, তাকে নতুনভাবে শুরু করবার সুযোগ করে দেন মামুনুর রাশিদ। মাসুম আজিজ হয়ে ওঠার পেছনে যার রয়েছে আসামান্য অবদান।
১৯৮২ সালে তিনি আর এক অভিনয় শিল্পী পাবনার মেয়ে সাবিহা জামানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সাবিহা জামানও একজন সক্রিয় মঞ্চশিল্পী। এ ছাড়া টেলিভিশন, চলচ্চিত্র এবং বেতার এ রয়েছে তার সক্রিয় পদচারনা। এই নাট্য দম্পতির এক ছেলে এক মেয়ে। মেয়ে প্রজ্ঞা আজিজ সংগীত ও চারুশিল্পি, ছেলে উৎস জামান স্থপতি এবং অভিনয়ের সাথে জড়িত।
মাসুম আজিজের অভিনীত উল্লেখযোগ্য মঞ্চ নাটক ইন্সপেক্টর জেনারেল, রা¶স-খোক্কস, এই দেশে এই বেশে, আমিনা সুন্দরী, ইঙ্গিত, বিষাদ-সিন্ধু, জলদাস, আপদ এবং ট্রায়াল অব সূর্যসেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আপদ গল্পকে নাট্যরুপ দিয়ে নির্দেশনা দেন। তার রচনা ও নির্দেশনায় ঢাকা পদাতিক এর প্রযোজনা ট্রায়াল অব সূর্যসেন। তার রচনা ও নির্দেশনায় ‘থিয়েটার মঞ্চ’ থেকে মঞ্চে আসে ‘কাঠের গড়া’। নাট্যরচনা-আপদ, ট্রায়াল অব সূর্যসেন, মাদারিকা খেল, টেলিফোন ম্যাজিক, কাঠের গড়া।
মঞ্চের দাপুটে অভিনেতা ১৯৮৫ সালে টেলিভিশন মাধ্যমে অভিনয় শুরু করেন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ৪০০ এর অধিক নাটকে অভিনয় করেন। ২০০০ সালে ‘একজন আয়নার লস্কর’ নাটকের জন্য মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার এবং বাচসাস পুরস্কার লাভ করেন। তার নিজের নির্দেশনায় নির্মিত নাটক ‘কদম আলী বয়াতি’ এর জন্য বাচসাস পুরস্কার পান। এর পরবর্তীতে একাধিক বার বাচসাস সহ আরো অনেক সম্মাননায় তিনি ভূষিত হন। হুমায়ুন আহমেদ এর ধারাবাহিক নাটক ‘উড়ে যায় বকপক্ষী’ এর মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর সবার কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। হুমায়ুন আহমেদের ’২৪ ক্যারেট ম্যান’ একক নাটক এর জন্য লাভ করেন ঝিলিক চ্যানেল আই পুরস্কার। তার অভিনিত উল্লেখযোগ্য নাটক- এক জন আয়নার লস্কর, উড়ে যায় বকপক্ষী, ২৪ ক্যারেটম্যান, কদম আলী বয়াতি, বিরস গল্প, বাবলা কাঠের গলুই, তিন গ্যাদা, কফিল উদ্দিন মহুরী, সাকিন সারি শুরি,চম্পা হাউস,বিশ্বাস। তার রচনা ও নির্দেশনায় নির্মিত উল্লেখযোগ্য নাটক- পাগলা ঘন্টা, সিন্ধ্যু সারষ, বোধন, কদম আলী বয়াতি, বিরস গল্প, বাবলা কাঠের গলুই, পোট্রেট, কফিল উদ্দিন মহুরী,ইতুনি।
এর মাঝে তিনি বারবার ফিরে গেছেন শিল্পের সেই ধারায়, যেখান থেকে শুরু হয়েছিল তার শিল্পের যাত্রা। ভুপেন হাজারিকার সরাসরি সান্নিধ্য ভীষণ অনুপ্রানিত করেছিল তাকে। ভুপেনের গান গেয়েছেন শেষবেলা পর্যন্ত। নিজে লিখেছেন এবং সুর করেছেন অনেক গান। এক সময় সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে প্রকাশ করেন গানের অ্যালবাম ‘কর্কশ প্রেসনোট’।
টেলিভিশন নাটক এর সাথে সাথে তিনি চলচ্চিত্র এবং বাংলাদেশ বেতার এ অভিনেতা, গল্পকার এবং নির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। ২০০৫ সালে ‘মমতাজ’ চলচ্চিত্র এর মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। এর পর একে একে অভিনয় করেন ঘানি, গহীনে শব্দ, গেরিলা, গাড়িওয়ালা, লালচর, ইন্দুবালা, আমরা একটা সিনেমা বানাবো সহ আরো অনেক চলচ্চিত্রে। ২০০৬ সালে ঘানি চলচ্চিত্রের জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। ২০১০ সালে গহীনে শব্দ চলচ্চিত্র এর জন্য অ্যামেরিকার ‘সাইলেন্ট রিভার ফিল্ম ফেস্টভাল’ এ শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পান। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকারের অনুদান এ নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র ‘সনাতন গল্প’। চলচ্চিত্রটি ২০১৯ এ ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব এ শ্রেষ্ঠ সমালোচক ফিপ্রেসিজুরি পুরস্কার লাভ করেন। তার রচনায় ইন্দুবালা চলচ্চিত্রটি দর্শক নন্দিত হয়। এই গুনি শিল্পীকে বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালে শিল্পে তার অসামান্য অবদানের জন্য একুশে পদক প্রদান করেন।
মাসুম আজিজ শিল্পের ভুবনে এক অসম্ভব ও অকল্পনীয় বিরুদ্ধ স্রোতে দাপিয়ে বেরিয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকে ইতি নি অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ধারার সাথে যুক্ত ছিলেন। শিল্পের বিভিন্ন ধারার নানা সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলন। তিনি অভিনয় শিল্পী সংঘ, ডিরেক্টরস গিল্ডও প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েসন এ সফলভাবে নানা দায়িত্ব পালন করেন।এই গুণী শিল্পী মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৭ অক্টোবর ২০২২ ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।