সমাজে কিছু মানুষ শুধু নিজের পরিবার পরিজন নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং আত্মীয়-স্বজনের ব্যাপারে থাকে উদাসীন। আবার এমন বহু লোক আছে, যারা নিজের পরিবার-পরিজনের কথা ভুলে অর্থকড়ি বন্ধু-বান্ধবের পেছনেই ব্যয় করে।
আয়াতে এমন লোকদের হুঁশিয়ার করে দেওয়া হয়েছে। মাতা-পিতার পরে প্রথমেই আত্মীয়-স্বজনের অধিকার বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। এর পর অন্যদের কথাও ভাবতে হবে। আবার এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করা থেকেও দূরে থাকতে হবে, যাতে বিষয়টি অপচয় পর্যন্ত না গড়ায়।
রাসূলুল্লাহ (সা:) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে, সে যেন তার আত্মীয়তার বন্ধন অটুট রাখে। (বুখারি, হাদিস: ৬১৩৮)।
মানুষ একে অপরের সঙ্গে বিভিন্ন সম্পর্কে জড়িত। মানুষের মাঝের এই সম্পর্কের নাম হচ্ছে ‘আত্মীয়তা’। পরস্পরের সঙ্গে জড়িত মানুষ হচ্ছে একে অপরের ‘আত্মীয়’। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে আত্মীয়তার সম্পর্ক সর্বতোভাবে জড়িত। আত্মীয় ছাড়া এ জীবন অচল। আত্মীয়দের সহযোগিতা, সহমর্মিতা ও ভালোবাসা নিয়েই মানুষ এ পার্থিব জীবনে বেঁচে থাকে। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় না থাকলে জীবন হয়ে যায় নীরস, আনন্দহীন, একাকী ও বিচ্ছিন্ন।
‘আত্মীয়’ শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বজন, জ্ঞাতি, কুটুম্ব। এর আরবী প্রতিশব্দ হচ্ছে (আর-রাহিমু) বা (যুর রাহিমে) । অর্থাৎ এমন পথ-পন্থা যাতে দু’ব্যক্তি, দল বা দেশ পরস্পরের সঙ্গে সদাচরণ করে বা পরস্পরে আলোচনা করে’।
আবার কেউ কেউ বলেন, ‘আত্মীয় হচ্ছে তারা যাদের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে, তারা সম্পদের উত্তরাধিকারী হোক বা না হোক, মাহরাম হোক বা না হোক’। অর্থাৎ আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে আত্মীয় বলা হয়।
আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার অর্থ ও তাৎপর্য হচ্ছে স্বজন ও আপনজনের সার্বিক খোঁজ-খবর রাখা ও তাদের সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করা। ইবনুল আছীর বলেন, ‘এটা হচ্ছে বংশীয় ও বৈবাহিক সম্পর্কীয় আত্মীয়দের প্রতি অনুগ্রহ-অনুকম্পা প্রদর্শন করা, তাদের প্রতি সদয় ও সহানুভূতিশীল হওয়া, তাদের অবস্থার প্রতি খেয়াল রাখা, যদিও তারা দূরে চলে যায় এবং খারাপ আচরণ করে ।
আত্মীয় প্রধানত দু’প্রকার। যথা- ১. রক্ত সম্পর্কীয় বা বংশীয়। যেমন: পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, ভাইবোন, চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি, ২. বিবাহ সম্পর্কীয় যেমন: শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, শ্যালক-শ্যালিকা ইত্যাদি
আবার পরিত্যক্ত সম্পদের অধিকারী হওয়ার দিক দিয়ে আত্মীয় দু’প্রকার যথা: ১. উত্তরাধিকারী; যেমন- পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতি, ২. উত্তরাধিকারী নয়; যেমন- চাচা-চাচী, মামা-খালা ইত্যাদি।
আত্মীয়-স্বজনের হক সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বিশদ বর্ণনা রয়েছে।
আত্মীয়-স্বজনের হক সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘তোমরা আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় করে দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরের হকও আদায় করো। আর কোনোভাবেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান তার প্রতিপালকের খুবই অকৃতজ্ঞ’। (সূরা: বনী ইসরাইল, আয়াত: ২৬-২৭)
মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেছেন যে, ‘আর আল্লাহর বন্দেগী কর এবং তার সঙ্গে কাউকে শরীক করো না, এ ছাড়া মাতা-পিতার সঙ্গেও উত্তম আচরণ কর, আর উত্তম আচরণ কর নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে।’ (সূরা: আন-নিসা, আয়াত: ৩৬)।
পবিত্র কোরআন মাজীদে আল্লাহ পাক এ বিষয়ে আরো বলেছেন যে, ‘হে মানবজাতি, তোমরা তোমাদের প্রভুকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক আত্মা থেকে, আর তা থেকে সৃষ্টি করেছেন তার স্ত্রীকে এবং তাদের থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন বহু পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে, তাদের হক আদায় করে দাও। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের পর্যবেক্ষক (সকল খবর জানেন)’ (সূরা: নিসা, আয়াত: ০১)
হজরত আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করিম (সা:)-কে বলতে শুনেছি যে, ‘যে লোক রিজিক প্রশস্ত ও আয়ু বৃদ্ধি করতে চায়, সে যেন তার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে,। (সহীহ বুখারী, হাদীস: ৫৫৫৯)।
আমরা অনেকেই সাধারণ বিষয় নিয়েও ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দীর্ঘদিন পর্যন্ত কথাবার্তা বন্ধ রাখি। এমনকি অনেকে এভাবে রাগ করে সারাজীবন দেখা-সাক্ষাৎ কথাবার্তা বন্ধ রাখে। অথচ এ ব্যাপারে (স:) স্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেছেন। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কোনো মুসলমানের জন্য তিন দিনের বেশি তার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বন্ধ রাখা জায়েয নেই’। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৬২৯৫)।
: আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রেহম (আত্মীয়তার সম্বন্ধ) আল্লাহর আরশের সঙ্গে ঝুলন্ত রয়েছে। সে বলে, যে ব্যক্তি আমার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক রাখবেন। আর যে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে আল্লাহ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবেন। (সহীহ মুসলিম, হাদিস: ৬২৮৮)।