নিজস্ব প্রতিবেদক :
সাইবার অপরাধের ঘটনায় সরাসরি মামলা করার সুযোগ তৈরিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অধীনে একটি বিশেষ থানা চালু হচ্ছে।
এই থানার দায়িত্বে থাকবেন একজন অতিরিক্ত ডিআইজি, যা পুলিশে এটাই প্রথম।
সাইবার থানার বিস্তারিত রূপরেখা নিয়ে একটি খসড়া তৈরির কাজ চলছে, যার চূড়ান্ত অনুমোদনের প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। তাই ‘শিগগিরই’ পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকায় একটি সাইবার থানা চালু করার চিন্তা-ভাবনা হচ্ছে।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের ডিআইজি শাহ আলম জানান, পুলিশ সদর দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে প্রশাসনিক পুনবির্ন্যাস সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটিতে (নিকার) খসড়াটি পাস হওয়ার পর সাইবার থানার কার্যক্রম পুরোদমে চলবে। তবে নিকারে পাসের আগেই তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাইবার থানা তৈরি করার জন্য বিভিন্ন স্থানে ভবন খোঁজা হচ্ছে। পছন্দমতো কোথাও ভবন না পেলে সিআইডি কার্যালয়ের একটি ফ্লোরে এই থানার কাজ শুরু হবে।
শাহ আলম বলেন, এখন সিআইডির সাইবার ক্রাইম সেন্টার ভুক্তভোগীদের সমস্যা শুনে প্রতিকারের জন্য থানায় অভিযোগ করতে বা আদালতে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। কিন্তু সাইবার থানা হলে ভুক্তভোগীরা সেখানেই মামলা করতে পারবেন। ফলে তার সেবা পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এখন সাইবার ক্রাইম সেন্টারের হটলাইন ০১৭৩০৩৩৬৪৩১ নম্বরে দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে ফোন করে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত সমস্যায় পরামর্শ নেওয়া যায় বলে জানান তিনি।
সেক্ষেত্রে সারা দেশের মানুষের জন্য এই থানা থেকে সেবা নেওয়ার সুযোগ দিতে অনলাইনে মামলার ব্যবস্থা রাখা হবে কি না জানতে চাইলে ডিআইজি শাহ আলম বলেন, “আগে চালু হোক। পরে ধাপে ধাপে সব কিছু করা যাবে।”
তবে গত ৬ জুলাই সিআইডি প্রধান পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মাহবুবুর রহমান সিআইডি কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সাইবার থানাটি ঢাকায় স্থাপন করা হলেও সারা দেশ থেকে ভুক্তভোগীরা অনলাইনে এই থানায় অভিযোগ দায়েরের সুযোগ পাবেন।”
সাইবার থানার সাংগঠনিক কাঠামো কেমন হবে সে বিষয়ে শাহ আলম বলেন, একজন অতিরিক্ত ডিআইজির নেতৃত্বে এই থানার দুটি শাখা থাকবে- মনিটরিং ও তদন্ত, যার দায়িত্বে থাকবেন দুজন পুলিশ সুপার।
দুই শাখায় দুজন করে চারজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, আটজন সহকারী পুলিশ সুপার, ৩০ জন পুলিশ পরিদর্শক ও অন্তত ৬০ জন এসআইসহ এই থানায় তিন শতাধিক জনবল থাকবে।
পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামো অনুযায়ী, এখন থানাগুলোর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে পরিদর্শকরা দায়িত্ব পালন করেন। সাইবার থানা এমন প্রথম থানা হবে, যেখানকার ওসি হবেন তার চেয়ে কয়েক ধাপ উপরের একজন পুলিশ কর্মকর্তা।
সাইবার থানার ধারণা অপেক্ষাকৃত নতুন হলেও বিশ্বের অনেক দেশে এই কার্যক্রম চলছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সিআইডিতেও গতবছর সাইবার থানা চালু করা হয়েছে। তবে সেখানে থানার ওসি একজন পরিদর্শক।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিআইজি শাহ আলম বলেন, কোন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে পুলিশের যে কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া যায়। এতে বিধিবিধানের কোনো ব্যত্যয় হয় না।
সাইবার অপরাধ বিষয়ে সিআইডির প্রশিক্ষিত দেড় হাজারের বেশি পুলিশ সদস্য বিভিন্ন থানায় কর্মরত রয়েছেন বলে জানান তিনি।
সাইবার অপরাধের মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ওসি মওদুত হাওলাদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফেইসবুক হ্যাকড হয়েছে এবং অশ্লীল ছবি পোস্ট করা হয়েছে এ রকম অভিযোগ মাসে অন্তত একটি হলেও থানায় আসে। তখন সাধারণ ডায়রি নেওয়া অথবা সাইবার ক্রাইম ইউনিটগুলোতে ভুক্তভোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
কলেজপড়ুয়া মেয়ের ছবি দিয়ে ভুয়া ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা হচ্ছিল জানতে পেরে দ্রুত গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার ইউনিটে চলে যান পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মো. মামুন। তাদের পরামর্শে থানায় গিয়ে অভিযোগ দেন তিনি।
তার মতো নয়াবাজারের মন্টু মিয়াও একই ধরনের সমস্যায় পড়েছিলেন। তিনিও সাইবার ক্রাইম বিভাগে গিয়ে পরে স্থানীয় থানায় জিডি করেন।
সাইবার থানা হলে এই দৌড়াদৌড়ি ছাড়াই এক জায়গা থেকে সব সেবা পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তারা।
সাইবার থানার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ। এর ফলে ভুক্তভোগীরা সহজেই অভিযোগ সাইবার থানায়ই করতে পারবেন।
“গুজব, রাজনৈতিক অপপ্রচার, উগ্রবাদ, গ্যাং কালচার, মিথ্যা সংবাদ, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি- এর সবই হচ্ছে প্রযুক্তির মাধ্যমে।”
তিনি বলেন, “ব্যক্তি পর্যায়ে ভুক্তভোগীদের মধ্যে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি দেওয়ার ঘটনা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কপিরাইট আইন লংঘন, অনলাইনে পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণা এবং অনলাইনে কাজ দেওয়ার কথা বলে প্রতারণা।
“দেশে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতারণাও। আর ছবি বিকৃত করে অনলাইনে অপপ্রচারের ঘটনাতো রয়েছে, অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের ঘটনাও ঘটে থাকে।”
সাইবার অপরাধের ধরন নিয়ে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের সাইবার ক্রাইম বিভাগে দায়িত্বরত একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “৯০ শতাংশ অভিযোগই আসে ফেইসবুক হ্যাকড, অন্যের ছবি দিয়ে নতুন ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা, সাইবার বুলিং ও পাইরেসি সংক্রান্ত। আর অভিযোগকারীদের অধিকাংশই নারী ও অল্প বয়সী।”
বাংলাদেশে রেলওয়ে ও নৌ থানা মিলিয়ে ৬৬০টি থানা রয়েছে। নিকার সাইবার থানার অনুমোদন দিলে থানার সংখ্যা আরও একটি বাড়বে।