অমিত হাসান হৃদয় ঢাকা জেলা প্রতিনিধি :
রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারিত রোগীরা এখন চরম আতঙ্কে আছেন। র্যাব জানিয়েছে, তাদের কাছে ৬ হাজার রোগীর রিপোর্ট রয়েছে। সেগুলো এখন যাচাই করে দেখা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনার মূল হোতা রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ রাজধানীতেই ঘাপটি মেরে আছেন। বিভিন্ন সময় তিনি প্রতারণার দায়ে আটক হয়েছিলেন, জেলও খেটেছেন। মিথ্যাকে কেন্দ্র করেই তার উত্থান। ভুয়া পরিচয় দিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করেছেন মানুষের সঙ্গে। তিনি একটা এমএলএম কোম্পানি খুলে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন, যার জন্য জেলও খেটেছেন। তার আরও অনেক নামে-বেনামে প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে লাইসেন্সও নেয়া হয়নি। জানা গেছে, তার এই উত্থানের বিষয়ে এলাকাবাসীও হতবাক। অবশ্য এলাকাতেও তাকে সবাই প্রতারক সাহেদ হিসেবেই চেনে। মঙ্গেলবার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর সাহেদের অপকর্ম নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। র্যাব জানিয়েছে, মূলত শুধু প্রতারণার মাধ্যমেই তার বিস্ময়কর উত্থান ঘটে । একসময় মাল্টিলেভেল মার্কেটিং ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলেন।
প্রতারণা মামলায় জেলও খেটেছিলেন। ২০১১ সালে দুবছর জেল খাটার পর তিনি বের হয়ে আসেন। তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩৩টি মামলা রয়েছে। তারপরও তাকে ধরার সাহস করেনি কোন সংস্থা। কারণ তিনি নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, কখনও গোয়েন্দা সংস্থার ঘনিষ্ঠ, আবার কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংশ্লিষ্ট বলে পরিচয় দিয়ে বেড়াতেন। নিজেকে মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জাহির করে অর্থের বিনিময়ে টকশোতে অংশ নিতে শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি রিজেন্ট হাসপাতালের কর্ণধার মোঃ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের। তার একাধিক নাম রয়েছে। প্রতারণর অন্যতম উপায় ছিল কৌশলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছবি তোলা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্পন্সর সহযোগিতা করে তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করতেন। এসব কিছু কাজে লাগাতেন নিজের স্বার্থে। অফিস, হাসপাতাল বা বাসা সবখানেই সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তি বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উর্র্ধতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে তোলা ছবি বাঁধাই করে টাঙিয়ে রাখতেন। তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে হুমকি দিতেন পুলিশের কর্মকর্তাদের নামে। চার-পাঁচ বছর ধরে নিজেকে কথিত বুদ্ধিজীবী বা রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন তিনি। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ বা রাজনীতি গবেষণা কেন্দ্র নামে একটি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি। এজন্য অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন টকশোতে অংশ নিতেন। টকশোতে বিরোধী রাজনীতিকদের বিষয়ে তুলোধুনা করতেন। দুর্ধর্ষ এই প্রতারক সাহেদের বাড়ি সাতক্ষীরায়। গরিব ঘরের সাহেদের উত্থান ছিল বিস্ময়কর। শুধু প্রতারণায় স্বল্প সময়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এখন বিভিন্ন টিভিতে মধ্যরাতের টকশোতে এসে নীতিবাক্য বলে নিজেকে বুদ্ধিজীবী বলে পরিচয় দেন। বর্তমানে মোঃ সাহেদ হিসেবে পরিচয় দিলেও তার আসল নাম মোঃ সাহেদ করিম।
পিতা সিরাজুল করিম, মাতা মৃত সুফিয়া করিম। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি। তার মা মৃত্যুবরণ করেন ৬ নবেম্বর ২০১০ সালে। তিনি কখনও কখনও মেজর ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কর্নেল ইফতেকার আহম্মেদ চৌধুরী, কখনও মেজর সাহেদ করিম হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তার আসল নাম জাতীয় পরিচয়পত্রে সাহেদ করিম লেখা। বর্তমানে তিনি মোঃ সাহেদ নামে আরেকজাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করছেন যার নাম্বার হলো : ২৬৯২৬১৮১৪৫৮৮৫। আর এ জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হয় ২৫-৮-২০০৮। কিন্তু তাতে তার মা মারা গেছে লেখা রয়েছে, অথচ তার মা মৃত্যুবরণ করেন ৬ নবেম্বর ২০১০ সাল। তাতেই প্রমাণ হয় এটাও ভুয়া। ঠিকানা হরনাথ ঘোষ রোড, লালবাগ, ঢাকা-১২১১ রয়েছে। গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলায়। এক নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও প্রতারণা বাটপারি করে আজ শত শত কোটি টাকার মালিক। ফকরুদ্দন সরকারের সময় তিনি ২ বছর জেলও খাটেন। জেল থেকে বের হয়ে সাহেদ ২০১১ সালে ধানম-ির ১৫নং রোডে এমএলএম কোম্পানি বিডিএস ক্লিক ওয়ান নাম বাটপারি ব্যবসা প্রষ্ঠান খুলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাত করেন। সে সময় তার নাম ছিল মেজর ইফতেকার করিম চৌধুরী। নিরীহ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্রতারণার দায়ে উত্তরা থানায় ৮টি মামলাসহ রাজধানীতে ৩৩টি মামলা রয়েছে। অন্যদিকে তিনি মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক বিমানবন্দর শাখা থেকে ৩ কোটি টাকা লোন নেন। সেখানে তিনি নিজেকে কর্নেল (অব.) পরিচয় দিয়ে কাগজপত্র দাখিল করেন।
ওই ঘটনায় আদালতে ২টি মামলা বিচারাধীন। সাহেদ প্রকাশ্যে অনেক প্রভাবশালীর নাম ব্যবহার করেই মানুষকে হুমকি-ধমকি দিয়ে থাকেন। তার গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও সাইরেনযুক্ত হর্ন ব্যবহার করে। তিনি নিজেকে কখনও মেজর, কর্নেল, সচিব পরিচয় দিতেন। এভাবেই তিনি উত্তরা ১১নং সেক্টরের ১৭নং রোড, বাড়ি নং-৩৮-এ হাসপাতাল করেন। মূলত করোনার মহামারী তার জীবনে বড় আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। হাজার হাজার রোগীর নকল করোনা সনদ ও চিকিৎসা দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়াও প্রতারণার টাকায় তিনি উত্তরা পশ্চম থানার পাশে গড়ে তুলেছেন রিজেন্ট কলেজ ও ইউনিভার্সিটি, আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটি। যদিও এর একটিরও কোন বৈধ লাইসেন্স নেই। আর অনুমোদনহীন আরকেসিএস মাইক্রোক্রেডিট ও কর্মসংস্থান সোসাইটির ১২টি শাখা করে হাজার হাজার সদস্যদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন। এর আগেও তিনি উত্তরাস্থ ৪, ৭ ও ১৩ নম্বর সেক্টরে ভুয়া শিপিংয়ের ব্যবসা করেছেন সেই ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামেই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে মেরে দিয়েছে। বর্তমানে তার ভিজিটিং কার্ডে তিনি রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান পরিচয় দেন। কিছুদিন আগে তিনি একঅস্ত্রের লাইসেন্সও নিয়েছেন। অথচ অস্ত্রের লাইসেন্স করতে বার্ষিক ন্যূনতম ৩ লাখ টাকা ইনকাম ট্যাক্স দেয়া লাগে। তিনি এক টাকাও টেক্স দেন না। সাহেদের কয়েকগাড়ি রয়েছে যেগুলোর কোন বৈধ কাগজপত্র নেই।
তার গাড়িতে ভিফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড, অবৈধ ওয়ারল্যাস সেট আর অস্ত্রসহ ৩ জন বডিগার্ড থাকার কারণে সাধারণত পুলিশ তার গাড়ি থামাবার সাহস পায় না। তার অফিসে লাঠিসোটা রাখা হয়। এমনকি তার অফিসের ভেতরে একটি টর্চার শেলও রয়েছে। কোন পাওনাদার টাকা চাইতে আসলে পাওনাদারদের সেখানে টর্চার করা হয়। পুলিশ ও র্যাব জানিয়েছে- তার বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা রয়েছে দেশের বিভিন্ন থানায়। এত সব মামলা থাকার পরও সাহেদ ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ মামলায় গ্রেফতার ৭ জনের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। করোনা পরীক্ষার জন্য আসা রোগীদের বিনামূল্যে নমুনা সংগ্রহ করানোর কথা থাকলেও টাকা নেয়া এবং নমুনার অর্ধেকের বেশি পরীক্ষা না করেই রিপোর্ট দেয়াসহ রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অনেক অনিয়ম ও প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। সেসব ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে গ্রেফতারদের সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়।