সাম্প্রতিক সময়ে ডলার পাচারের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া সীমান্তে কড়া অবস্থান নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটও তৎপর রয়েছে। বিজিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলারপাচার ঠেকাতে দেশের সব সীমান্ত এলাকায় কঠোর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পুলিশ ও র্যাব ডলার মজুদকারীদের তালিকা তৈরিতে মাঠে কাজ করছে।
ডলার পাচারের বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা-৬ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল শাহ মো. ইশতিয়াক বলেন, বিজিবির একটি বিশেষ টহলদল ফুলবাড়ি সীমান্ত পিলার ৮৫ থেকে নিয়ে ৩০০ গজ বাংলাদেশের ভেতরে অভিযান চালায়। এসময় বিজিবির সদস্যরা দেখতে পান এক ব্যক্তি একটি ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে। বিজিবি তাকে চ্যালেঞ্জ করলে তিনি দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ধরা পড়ার ভয়ে লোকটি ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে পালিয়ে যান। এসময় বিজিবির টহলদল দুটি ভাগে বিভক্ত হয়। একটি দল চোরাকারবারিকে ধাওয়া করে, আর অপর দল ব্যাগ উদ্ধার করে। এসময় ব্যাগে কাগজে মোড়ানো আটটি প্যাকেট পাওয়া যায়। যাতে মেলে মোট ৮০ হাজার ইউএস ডলার।
বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, কিছু দিন আগে যশোর সীমান্তে একটি ব্যাগ থেকে আমরা ৩০ হাজার ডলার উদ্ধার করি। ডলার পাচার ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে বিজিবি। একই সঙ্গে সীমান্ত অপরাধ দমনে বাড়ানো হচ্ছে নজরদারি। ডলার যেই পাচার করতে যাক তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। সীমান্তে তল্লাশির ক্ষেত্রে ইমিগ্রেশন পুলিশ, কাস্টমসসহ ৩/৪ টি সংস্থা কাজ করে। আমরা ওইসব সংস্থার সাথে সমন্বয় করেই ডলার পাচার রোধে কাজ করছি। তল্লাশি করতে গিয়ে কোনো নিরপরাধ যাত্রী যাতে হয়রানির শিকার না হয়- সেদিকটিও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
এরই মধ্যে রাজধানীতে একটি আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ডলার মজুদকারী দুই ব্যবসায়ীর বাসায় অভিযান চালায়। তবে ওই অভিযানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ডলার উদ্ধার করতে পারেনি। অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া এক কর্মকর্তা বলেন, ১ কোটি টাকায় আনুমানিক ১ লাখ ডলার। এই ১ লাখ ডলার লুকিয়ে রাখা কোনো বিষয় নয়। তাই পর্যাপ্ত তথ্য নিয়েই ডলার মজুদকারীর বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে হবে।
র্যাবের আইন ও গণ মাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা ছাড়া ডলার মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো সম্ভব নয়। তবে র্যাব ডলার মজুদকারীদের গোপন মনিটরিং করছে। সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে ডলার মজুদকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।
ইতিমধ্যে ডলার নিয়ে খোলাবাজারে কারসাজি করায় দেশে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গত ২ আগস্ট পাঁচটি মানি চেঞ্জারের লাইসেন্স স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া ৪২ মানি এক্সচেঞ্জকে শোকজ করা হয়েছে। অভিযানে আরো নয় প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়ে এতদিন ডলারের ব্যবসা করে আসছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলারে অনিয়ম পেলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। এরই মধ্যে আমাদের অভিযানে পাঁচটি মানি চেঞ্জার হাউজকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তাদের কাছে নানা অনিয়ম পাওয়া গেছে। যাদের লাইসেন্স নেই তাদের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করা হয়েছে।
সরকারের একটি সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশ ভ্রমণের সময় তল্লাশি কার্যক্রমের শিথিলতার কারণে অনেক যাত্রী অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ ডলার পাচার করছেন। এছাড়া করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর ভ্রমণ, চাকরি, চিকিৎসা, ব্যবসাসহ নানা কারণে বাংলাদেশিদের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বাড়ায় ডলার সংকটের আরেকটি কারণ বলে মনে করেছে সংস্থাটি।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষ দিকে দুটি আলাদা কর্মসূচিতে দুইশ’র বেশি বাংলাদেশি বিদেশে যান। তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। বিমানবন্দরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ডলার পাচার করেছেন বলে তথ্য পেয়েছে সংস্থাটি।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর ডিবির প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, কেউ যদি অবৈধভাবে ডলার মজুত করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া কেউ অবৈধভাবে জাল ডলার তৈরি করে, সে তথ্য পেলেও চালানো হবে অভিযান। এ বিষয়ে আমরা তথ্য সংগ্রহ করছি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে জানা গেছে, তারা ঢাকাসহ সারাদেশে অবৈধ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা তৈরি শুরু করেছে। এরমধ্যে বিপুল সংখ্যক অবৈধ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান তারা খুঁজে পেয়েছে। এরমধ্যে হঠাৎ গজিয়ে উঠা অবৈধ মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আইন ভেঙ্গে শাখা খুলে অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সন্ধানও তারা পেয়েছে। শুধু নাম ভাড়া করেও বৈধ প্রতিষ্ঠান গুলো বিপুল অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব বৈধ ও অবৈধ প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা মূল্যের বৈদাশিক মুদ্রা পাচার করছে। এদের বড় অংশই হুন্ডির সঙ্গে জড়িত। মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে হুন্ডি ব্যবসা জমজমাট হওয়ায় হাজার হাজার কোটি টাকার বৈদাশিক মুদ্রা কেন্দ্রী ব্যাংকের হিসেবে যোগ হচ্ছে না। আবার বিদেশ থেকে আসা বৈদাশিক মুদ্রা খোলা বাজার থেকে কিনে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে।