১৯৭১সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতির জীবনে এক ঐতিহাসিক দিন। এই দিবসের পর্যালোচনা করতে গেলে আমাদেরকে ইতিহাসে ফিরে যেতে হয়। কেন সেদিন বঙ্গবন্ধুর এই ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ?
১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট দ্বিজাতির ভিত্তিতে দুইটি ভূখন্ড নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। একটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান ও আরেকটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। দুইটি ভূখন্ডের মাঝে দূরত্ব ছিল প্রায় ১২০০ মাইল।
পূর্ব পাকিস্তান ছিল জনসংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ। মাতৃভাষা বাংলার দিক দিয়েও পশ্চিম পাকিস্তানের দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালি জাতিকে সেদিনের সেই শাসকরা বিভিন্ন কায়দায় শোষণ ও নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয়। প্রথম আঘাত আসে ১৯৪৮ সালে। মায়ের ভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়। সেদিন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অন্যতম। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে জীবন দিতে হয় সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার সহ আরও অনেককে।
১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ ও পাঁচটি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্ট গঠন করা দলগুলো হচ্ছে আওয়ামী মুসলিম লীগ (বর্তমান আওয়ামী লীগ), কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম, গণতান্ত্রিক দল ও খেলাফতে রাব্বানী পার্টি। এই নির্বাচনে ৩০৯টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৮টি আসনে জয় লাভ করে। যুক্তফ্রন্টের শরিক দলের মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ (যার উলে¬খযোগ্য নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান) আসন পেয়েছিল ১৪৩টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮টি, নেজামে ইসলাম ২২টি, গণতান্ত্রিক দল ১৩টি এবং খেলাফতে রাব্বানী পার্টি পায় ০২টি আসন। নির্বাচিত এই যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব লাভ করেন। কিন্তু এ সরকার বেশিদিন টিকতে পারে নাই।
১৯৫৮ সালে তৎকালীন সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে নেয় এবং সামরিক আইন জারি করে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙ্গালীদের উপরে নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ এবং ১৯৫৮ সালের ১১ই অক্টোবর শেখ মুজিবর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। যার ফলে তাঁকে ১১৫৩ দিন কারাগারের অন্ধকারে দিন অতিবাহিত করতে হয়।
তাতেও পশ্চিমারা ক্ষান্ত হয়নি। যার ফলশ্রুতি ছিল পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালি জাতিকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করবার জন্য শিক্ষাকে সংকুচিত করে একটি শিক্ষানীতি প্রণয়ন। সেদিনও বাংলার ছাত্র সমাজ ঘরে বসে থাকে নাই। এর বিরুদ্ধে রাজপথে নেমে আসতেও দ্বিধাবোধ করে নাই। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে জীবন দিতে হয়েছিল ওয়াজিউল্লাহ, গোলাম মোস্তফা, বাবুল সহ আরো অনেককে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত করা হয়েছিল শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি সহ আরো অনেককে। এ আন্দোলনও পরিচালিত হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা মোতাবেক।
বাঙ্গালিদেরকে সকল প্রকার নির্যাতন থেকে মুক্ত করার লক্ষে ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির সম্মুখে ৬ দফা দাবি পেশ করেন। তিনি বাঙালি জাতির সর্বস্তরের জনগণকে এই দাবি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনের আহ্বান জানান। বাংলার জনগণ ছয় দফার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান।
৬ দফা দাবি সমূহ ঃ
১. শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃতি
২. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা
৩. মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৪. রাজস্ব, কর বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা
৫. বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা ও
৬. আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা ও নৌবাহিনী সদর দপ্তর স্থাপন।
এই ভাবে ৬ দফার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পাকিস্তান সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেফতার করতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তাকে আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করে। তবুও বাংলার জনগণ আন্দোলন থেকে পিছিয়ে যায় নি।
এই ৬ দফা আন্দোলনকে গতিময় করার জন্য ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে ১১ দফা দাবি পেশ করা হয়। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে আইয়ুব খান সরকারের পতন হয় এবং ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। শেখ মুজিবুর রহমান অন্ধকার কারাগারে থেকেও এই আন্দোলনের নির্দেশনা দেন। যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তানের সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য আসামিদেরকে নিঃশর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়। সেই সাথে সাধারণ নির্বাচন দেওয়ার ফলশ্রুতি প্রদান করেন এবং তৎকালীন পাকিস্থানের সামরিক সরকার ইয়াহিয়া খান ৭ই ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ ও ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ দিতে বাধ্য হন।
এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত ২৫১ জন জাতীয় সংসদ ও ২৬৭ জন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন জাতীয় সংসদের সদস্য এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন স¤পাদক মরহুম আব্দুর রব বগা মিয়া প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে আসন লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সকল নির্বাচিত সদস্যদেরকে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ডেকে এনে শপথ বাক্য পাঠ করান।
আওয়ামীলীগ তথা বাঙালিরা পাকিস্তানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হোক পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও উচ্চাভিলাষী কিছু রাজনৈতিক দল এটাকে মেনে নিতে পারে নি। আওয়ামীলীগ নির্বাচনে জয়লাভ করার পরও পাকিস্তানের সামরিক সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার লক্ষে আলোচনার কথা বলে টালবাহানা করে। বঙ্গবন্ধু একদিকে যেমন তাদের সাথে আলোচনা ও অন্যদিকে দেশবাসীকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন এবং ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসভার আহবান জানান।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন ও সাধারণ স¤পাদক আবদুর রব মিয়ার নেতৃত্বে এই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এতে মোহাম্মদ নাসিম, রফিকুল ইসলাম বকুল, বেবী ইসলাম, সোহরাব উদ্দিন সোবা, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু সহ ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগের সকল নেতৃবৃন্দ এই অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। এই আন্দোলনে আমিও একজন অংশীদার।
১৯৭১ সালে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষন শোনার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ রেসকোর্স ময়দানে জমায়েত হন এবং ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ সম্প্রচার করা হবে, এমন ঘোষণায় সারা বাংলার মানুষ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল যে বাঙালি জাতির মহানায়কের মুখ থেকে কি নির্দেশনা আসে তা জানার জন্য।
বঙ্গবন্ধু এই জনসভা উপলক্ষে জাতীয় নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনায় বসেন। অনেকে দাবি জানান তিনি যেন লিখিত বক্তব্যে দেন ও স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
৭ই মার্চ বাসা থেকে বের হবার পূর্বে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেসা মুজিব বঙ্গবন্ধুকে লিখিত বক্তব্য পাঠ না করার পরামর্শ দেন এবং বাঙ্গালি জাতিকে শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার লক্ষে নিজের রাজনৈতিক দক্ষতা, দেশ ও জনগনের মুক্তির জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহব্বান জানান।
একজন বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু আগেই বুঝতে পারতেন বাঙ্গালির ভাগ্যে আগামীতে কি হতে পারে। সেজন্য তিনি দেশের জনগণকে আগামী দিনের সকল পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করার জন্য আহব্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন তিনি যদি সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে বক্তব্য প্রদান করেন তাহলে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী তাকে মঞ্চ থেকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরে গ্রেফতার করবে। তিনি গ্রেপ্তার হলে বহির্বিশ্বের চাপে স্বাধীনতার আন্দোলন মাঝ পথে থেমে যাবে। এতে করে বাঙালির মুক্তির স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে।
তাই ৭ই মার্চ ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে ঘোষণা দিলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধু আহ্বান জানালেন, “প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।”
তিনি ঘোষণা করেন, “আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, আমি যদি হুকুম দিতে নাও পারি সংগ্রাম পরিষদ গঠন কর তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল¬াহ।”
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর উত্তাল রেসকোর্স ময়দানে বাংলার জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত ছিলঃ-
জাগো জাগো- বাঙালি জাগো,
পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা,
তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা,
তোমার নেতা আমার নেতা- শেখ মুজিব, শেখ মুজিব,
বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো- বাংলাদেশ স্বাধীন করো,
তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সেই সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন এবং সংগ্রাম পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবদুর রব বগা মিয়া, কমিউনিস্ট পার্টি থেকে ছিলেন প্রসাদ রায়, রণেশ মৈত্র, ন্যাপ থেকে ছিলেন আমিনুল ইসলাম বাদশা সহ আরো অনেকে। তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান ও পাবনার পুলিশ সুপার চৌধুরী আবদুল গফফার খান সহ প্রশাসনের আরো অনেকের পূর্ণ সমর্থন ছিল।
আজ ৭ই মার্চ ২০২২। হে পিতা মুজিব, তোমাকে বার বার মনে পড়ে। বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য আপোষহীন সংগ্রাম করে ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপট তৈরি করতে জীবন যৌবনের ৪ হাজার ৩’শ ৯৪ দিন তোমাকে কারা বরণ করতে হয়েছিল। হে মহান নেতা, আজকের এই দিনে তোমাকে জানাই হাজার সালাম।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক
বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন
সভাপতিঃ সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম- মুক্তিযুদ্ধ ‘৭১ পাবনা জেলা শাখা।
সাবেক উপদেষ্টাঃ পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ।
#চলনবিলের আলো / আপন