মুহাইমিনুল (হৃদয়), টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ
শাহনাজ বেগম।টাংঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার জিগাতলা গ্রামের আবু সাইদের মেয়ে।শাহনাজের বয়স যখন ২ কিংবা ৩ তখন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে তার বাবা- মায়ের।শাহনাজের মা তাকে নিয়ে যেতে চাইলেও নিতে দেয়নি তার পরিবার। মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হল শিশু শাহনাজ।
এরই মধ্যে বিবাহ করেন শাহনাজের বাবা।সংসারে এলো সৎ মা। সৎ মায়ের সংসারে নির্যাতনের শিকার শাহনাজ।বড় হতে লাগলেন চাচা-চাচির কাছে।এভাবেই দুটি বছর কেটে যায় শিশু শাহনাজের।এরপর আর পরিবারের কাছে থাকার ভাগ্য হয়নি শাহনাজের।মাত্র ৫ বছর বয়সে তার চাচা তাকে লালনপালনের জন্য দিয়ে আসেন অন্য একটি পরিবারের কাছে।
কিছুদিন পর সেই পরিবারের সাথে ঢাকায় চলে যান শাহনাজ।সেখানেও গিয়ে হারিয়ে যায় শাহনাজ।অনেক খোঁজাখুঁজির পরও তাকে পায়নি তার পরিবার। পরে তার বাবা আবু সাঈদ ঢাকার তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে রাখেন। এরই মধ্যে জীবন থেকে হারিয়ে গেল শাহনাজের ২০টি বছর।পরিবার-পরিজন ছাড়া একা একা কেমন কেটেছে শাহনাজ দীর্ঘ ২০টি বছর।৫ বছর বয়সে হারিয়ে যাওয়া শাহনাজ ২০ বছর পর ফিরে পেয়েছেন মা-বাবা ও তার পরিবার। শুধু একাই ফেরেননি, সঙ্গে নিয়ে ফিরেছে তার স্বামী-সন্তান। শাহনাজ খুঁজে পেলেন আসল পরিচয়।ঘরে সৎ মাকে ফিরে পেলেও ফিরে পাননি গর্ভধারিনী মাকে।
সম্প্রতি একজন রেডিও উপস্থাপক আর,জে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ নামের একটি অনুষ্ঠানে শাহনাজকে নিয়ে একটি ভিডিও প্রচার করা হয় এবং তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।অনুষ্ঠানের ভিডিও শাহনাজের পরিবারের নজরে আসে।পরে আর জে কিবরিয়ার সাথে যোগাযোগ করে গত ১৯ জুন শাহনাজকে তার পরিবার ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে।
দীর্ঘ ২০ বছর পর হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা তার পরিবার। এদিকে ছোট শাহনাজ এখন অনেক বড় হয়েছেন। বিয়ে করে স্বামীর সংসার। তিনি এখন এক পুত্র সন্তানের মা। পরিবারকে কাছে পেয়ে চলে যাওয়া ২০টি বছরের কষ্ট তিনি ভুলে গেছেন নিমেষেই।
সরেজমিনে সেখানে দেখা গেছে, শাহনাজ তার ১ বছরের পুত্র সন্তান নিয়ে পরিবারের সঙ্গে বেশ আনন্দে সময় কাটাচ্ছেন। তার পরিবারও তাকে পেয়ে খুশি। তার ফুটফুটে শিশুসন্তানকে আদর করছেন তার চাচা, ভাই ও ভাতিজারাসহ অনেকেই। এদিকে এত বছর পর বাড়িতে ফিরে আসায় তাকে দেখতে বাড়িতে ভীড় করছে গ্রামের মানুষ।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় শাহনাজের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ রায়হানের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন শাহনাজের মা তাকে নিয়ে যেতে চান। কিন্তু আমাদের পরিবারের কেউই রাজি ছিলাম না। পরে শাহনাজের বাবাকে রাজি করিয়ে একটি পরিবারের কাছে শাহনাজকে দেওয়া হয় লালনপালন করার জন্য। একদিন সেই পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় বেড়াতে গিয়ে শাহনাজ হারিয়ে যায়। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তখন ঢাকার তেজগাঁও থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন আমার চাচা আবু সাঈদ।
তিনি বলেন, আমার মা শাহনাজের জন্য সব সময় কান্নাকাটি করতেন। এখনো শাহনাজের ব্যবহৃত জামাকাপড়, জিনিসপত্র আমার মা যত্ন করে রেখে দিয়েছেন। এ জন্য কিছুদিন আগে আমি আমার ফেসবুক ওয়ালে শাহনাজের সন্ধান চেয়ে একটা পোস্ট করি। পরে সেই পোস্ট আমার বন্ধুবান্ধবসহ অনেকেই দেখেন।
রায়হান আরও বলেন, কিছুদিন আগে জনপ্রিয় রেডিও উপস্থাপক আর জে কিবরিয়ার ‘আপন ঠিকানা’ নামের একটি অনুষ্ঠানে আমার বোনকে নিয়ে একটা প্রোগ্রাম করেন। সেই ভিডিওটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে জিগাতলা গ্রামের এক সেনাবাহিনীর সদস্য জুয়েল বিদেশে বসে ভিডিওটি দেখে আমাকে খবর দেন। পরিচয় ও হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা মিলে যাওয়ায় আমরা তাকে আনতে ঢাকা যাই। ১৯ জুন স্বামী-সন্তানসহ শাহনাজকে ফিরে পাই। তারপর তাদের বাড়িতে নিয়ে আসি।
পরিবার ফিরে পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে শাহনাজ বলেন, আমার মা-বাবার বিচ্ছেদের পর আমার বয়স যখন পাঁচ বছর, তখন টাঙ্গাইলের একটি পরিবারের কাছে আমাকে লালনপালন করার জন্য দেওয়া হয়। ওই পরিবার আমাকে ঢাকায় নিয়ে যায়। তাদের বাসায় দুই বছর থাকার পর আমি একদিন হারিয়ে যাই। এরপর ঢাকার খিলগাঁও বাসাবোর কদমতলা এলাকার মাশুক আহমেদ আমাকে পেয়ে তার বাসায় নেন। সেখানেই আমি বড় হই। তারা আমাকে মেয়ের মতো করেই বড় করেছেন।
তিনি বলেন, তারা আমাকে নওঁগা জেলার বাসিন্দা আব্দুর কাদেরের সঙ্গে বিয়ে দেন। আমার স্বামী বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। একটি টেক্সটাইল কোম্পানিতে চাকরি করছেন। এদিকে আমার স্বামীও আমার পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে আন্তরিক ছিল। পরে ‘আপন ঠিকানা’ প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমি আমার পরিবারকে খুঁজে পাই।
শাহনাজ বলেন, ২০ বছর পর পরিবারকে খুঁজে পাব, সেটা ভাবতে পারিনি। আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন। আমার পরিবারকে খুঁজে পাওয়ার জন্য শুধু স্মৃতি ছাড়া আমার কাছে কিছু ছিল না। আমার স্বামীও সবকিছু জেনে শুনে আমাকে বিয়ে করেছে। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি অনেক ভালো মনের মানুষ। তারা আমাকে নিজের মেয়ের মতোই আদর-যত্ন করেন।