বৃহস্পতিবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৪৩ অপরাহ্ন

ই-পেপার

দুর্নীতির আখড়া পাবনার ভাঙ্গুড়া থানা

শাহিবুল ইসলাম পিপুল, বিশেষ প্রতিনিধি:
আপডেট সময়: বৃহস্পতিবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৫, ১০:৫৯ অপরাহ্ণ

পাবনার ভাঙ্গুড়া থানা বর্তমানে আইনের শাসনের পরিবর্তে একটি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। থানায় কর্মরত কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ বাণিজ্য, ক্ষমতার অপব্যবহার ও বেআইনি হয়রানির অভিযোগে সাধারণ নাগরিকদের জীবন চরমভাবে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, মানসিক ও প্রশাসনিক নির্যাতন এবং মোটা অংকের অবৈধ অর্থ আদায়ের অভিযোগ প্রতিদিনই নতুন মাত্রা পাচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব গুরুতর অনিয়মের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কোনো কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় অভিযুক্ত কর্মকর্তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। যদিও ভাঙ্গুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান দাবি করেছেন, সদ্য যোগদান করায় তিনি এসব বিষয়ে অবগত নন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের ১৩ মে ভাঙ্গুড়া উপজেলার অষ্টমনিষা ইউনিয়নে বিএনপির কার্যালয় ভাঙচুরের ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা উল্লেখ করে ময়ছের ফকির নামে এক ব্যক্তি ভাঙ্গুড়া একটি লিখিত থানায় অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে পুলিশ অভিযোগটিকে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারায় এজাহার হিসেবে জিআর ৩৫/২০২৫ নম্বরে নথিভুক্ত করে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পান উপ-পরিদর্শক (এসআই) রেজাউল করিম রেজা।

এই মামলাটিই বর্তমানে থানায় একটি ‘জাদুর প্রদীপে’ পরিণত হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। মামলায় ১৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাতনামা দেখানো হয় আরও ৪০ থেকে ৫০ জনকে। অথচ দীর্ঘ সময় পার হলেও পুলিশ একজন এজাহারনামীয় আসামিকেও গ্রেফতার করতে পারেনি। বরং নিরীহ সাধারণ মানুষকে ‘সন্দেহভাজন’ আখ্যা দিয়ে নিয়মিত আটক ও হয়রানি করা হচ্ছে, যা সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এই মামলার এজহারভুক্ত সকল আসামী আদালতে স্বেচ্ছায় হাজির হয়ে বিভিন্ন মেয়াদে জেলখেটে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

বেআইনি আটক ও ঘুষ আদায়ের অভিযোগ-

সর্বশেষ ১৫ ডিসেম্বর সোমবার সন্ধ্যায় স্থানীয় মাংস ব্যবসায়ী সাব্বীর হোসেন সুমন ও বে-সরকারী চাকরিজীবী বায়েজিদ ইসলামকে আটক করে এসআই রেজাউল করিম রেজা। সুমনকে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে এবং বায়েজিদকে বাড়ি থেকে আটক করেন। তবে আটকের সময় বা পরে তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানানো হয়নি।

সুমন উপজেলার পাথরঘাটা পৌরপাড়া এলাকার আয়েজ উদ্দিন মানিকের ছেলে এবং বায়েজিদ পুঁইবিল গ্রামের মহসীন প্রামানিকের ছেলে। স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, এই মামলা এখন একটি ‘ঘুষের খনি’তে পরিণত হয়েছে। যাকে ইচ্ছা মামলায় জড়িয়ে গ্রেফতার করা হচ্ছে এবং মুক্তির বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা দাবি করা হচ্ছে। অনেকে ঘুষ দিয়ে ছাড়া পেলেও ভবিষ্যৎ হয়রানির আশঙ্কায় নীরব থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। যারা দিতে পারছেন না, তাদের ওপর চলছে নিয়মিত নিপীড়ন।

বিশেষ করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত পরিবারগুলোকে টার্গেট করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ হিসেবে এই মামলা ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে পুরো এলাকায় ভয়, আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে। আটক ঐ দুই ব্যক্তিদের মঙ্গলবার এই মামলায় সন্দেহভাজন দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে পুলিশ।

 

মানববন্ধনের পরও ব্যবস্থা নেই-

স্থানীয়দের অভিযোগ, থানার কর্মকর্তাদের মধ্যে এসআই রেজাউল করিম রেজাই আটক, হয়রানি ও ঘুষ আদায়ের মূল কুশীলব। এক মাস আগে মাসুদ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ঘুষ দাবি করার ঘটনায় এলাকাবাসী মানববন্ধন করলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বরং প্রশাসনিক নীরবতার সুযোগে তিনি আরও আগ্রাসী হয়ে উঠেছেন বলে অভিযোগ।

এই মামলায় কতজন এজাহারভুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই রেজাউল করিম রেজা বলেন, “তদন্তনাধীন মামলার কোনো তথ্য দেওয়ার সুযোগ নেই।” ঘুষ দাবি ও মানববন্ধনের বিষয়ে প্রশ্ন করার আগেই তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

 

তদন্তের নামে ঘুষ, ন্যায়বিচারের মৃত্যু-

অন্যদিকে, এই থানায় কর্মরত উপ-পরিদর্শক সুব্রত কুমারের বিরুদ্ধেও তদন্ত প্রতিবেদনে পক্ষপাতিত্ব ও ঘুষ আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভুক্তভোগী জানান, পারিবারিক ঝামেলায় দায়ের একটি মামলায় সুব্রত তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেন। প্রথমে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে সরাসরি পাঁচ হাজার টাকা নেন এবং পরবর্তীতে দুই দফায় ২০ হাজার ও পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে মোট ৩০ হাজার টাকা আদায় করেন। ভুক্তভোগীর ভাষায়, “এই কর্মকর্তার হাতে তদন্ত মানেই ন্যায়বিচারের মৃত্যু।”

এ বিষয়ে জানতে এসআই সুব্রত কুমারের মুঠোফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

অভিযোগ ছাড়াই হয়রানি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ-

থানার আরেক কর্মকর্তা সহকারী উপ-পরিদর্শক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধেও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। কোনো মামলা বা অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মিজানুর রহমানকে হয়রানি করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, শফিকুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানপ্রধানকে ফোন করে নির্দেশ দিয়েছেন মিজানুর যেন তার সঙ্গে দেখা না করে এবং প্রতিষ্ঠানে না আসে।

মিজানুর রহমান বলেন, “আমার কারো সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই, থানায় কোনো অভিযোগ বা আদালতে মামলা নেই। তবুও পুলিশ আমাকে হয়রানি করছে। আমি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।”

নিরীহ মানুষদের হয়রানির বিষয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক নূর মুজাহিদ স্বপন বলেন, “পুলিশ মামলায় নাম থাকা (এজাহারভুক্ত) আসামিদের গ্রেফতার করতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষকে ধরে বিস্ফোরক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও অনুচিত। আমরা দলীয়ভাবে থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলবো।”

এবিষয়ে ভাঙ্গুড়া থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমি এই থানায় সদ্যই যোগদান করেছি। এই সকল কর্সকান্ড সম্পর্কেন আমি অবগত নই। তবু বিষয়গুলো সম্পর্কে খোঁজ নেয়া হবে।

পাবনা পুলিশ সুপার মোঃ আনোয়ার জাহিদ জানিয়েছেন, তিনি বর্তমানে রাজশাহীতে একটি প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করছেন। বিষয়টি জানতে তার ব্যবহৃত মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হলে তিনি পরে বিস্তারিত জানানোর আশ্বাস দিয়েছেন।

পাবনা জেলা উকিল বারের সদস্য এ্যাডভোকেট রেজাউল করিম পলাশ বলেন, “যে কোনো পুলিশি পদক্ষেপ অবশ্যই সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী হতে হবে। মামলার এজাহারভুক্তরা যদি আদালতে হাজির হয়ে জামিনে থাকে, তবে সাধারণ মানুষকে ‘সন্দেহভাজন’ দেখিয়ে আটক করা, কোনো মামলা ছাড়াই ব্যক্তিকে কর্মস্থলে যেতে বাধা দেওয়া এবং বেআইনি হয়রানি করা সম্পূর্ণভাবে অবৈধ ও সংবিধানবিরুদ্ধ। ঘুষ আদায় বা ক্ষমতার অপব্যবহারে যে কোনো তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ তদন্ত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ পদক্ষেপ নিশ্চিত করতে”।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর