আমরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর নেগেটিভ সংবাদ গণমাধ্যমে পেয়ে থাকি। পুলিশের ভালো কাজের সংবাদগুলো গণমাধ্যমে প্রায় সময় নজরে পড়ে না। আমি একজন গণমাধ্যম কর্মী হওয়ার সুবাদে পুলিশ বাহিনীর ভালো মন্দ প্রায় সংবাদ গুলোই পেয়ে থাকি। এবং সব সময় চেষ্টা করি সেটি সংবাদ আকারে প্রকাশ করতে। তবে সবচেয়ে পরম সত্য হলো এই যে পুলিশ বাহিনীর যে কোন সদস্যের বিষয়ে যদি তার প্রকৃত সার্বিক কর্মকান্ডের বিষয় গুলো তুলে ধরা যায় সেক্ষেত্রে অনেকেই ভেবে নেয় উক্ত সংবাদ কর্মী পুলিশের সহযোগী এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিরূপ মন্তব্যের সম্মুখীন হতে হয় উক্ত সংবাদ কর্মীকে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ সদস্যের ভালো কাজের বিষয় গুলো নিয়ে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হতে অনীহা থাকায় সেগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়না। কিন্তু আজ পুলিশের মনবল যখন নিম্নমুখী এবং পুলিশ সদস্যরা অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে সর্বদা ভয় এবং আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে তখনও একজন পুলিশ সদস্য পূর্বের মতোই আতঙ্ক এবং ভয়কে জয় করেই ক্ষতিগ্রস্থ কয়েকটি পরিবারের বাড়িঘর আসবাবপত্র এবং পশু সহ সবকিছুকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছেন। আমার পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নজরে আসে দৃশ্যটি। তার এই দায়িত্ব দেখে আমি নিজেও তাকে সহযোগিতা করেছি। পাবনা জেলায় যে ব্যক্তিটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সফলভাবে করে থাকেন তার নাম হয়তো অনেকেই জানেনা। এবার আরো কিছু ঘটনা জেনে নেয়া যাক, উল্লেখযোগ্য চাঞ্চল্যকর কয়েকটি ঘটনা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো, জেলার চাটমোহর থানা এলাকার প্রাসীর স্ত্রী এবং শিশু সন্তানকে হত্যার ঘটনা, একই থানা এলাকায় ধর্ষণ ও হত্যার শিকার নয় বছরের শিশু কল্পনা হত্যার ঘটনা, পাবনা সদর থানা ও সুজানগর থানা এলাকার বাসিন্দা লিবিয়া প্রবাসী অপহরণের ঘটনায় সুকৌশলে বাংলাদেশে থেকেই তাদেরকে উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর, এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অশালীন ছবি ছেড়ে ব্যাক্লমেইলের শিকার স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে তাদের সহযোগিতা করে অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা ও জেলা শহরের সকলের প্রিয় মূখ পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক অধ্যাপক জহরলাল বসাক তুলসীর উপর হামলাকারীদের ২৪ ঘন্টার মধ্যে সনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আশা সহ অধিকাংশ ডাকাতি, অস্ত্র এবং মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা। আসলে আমি একটি ঘটনা স্বচক্ষে দেখে বিবেকের তাড়নায় আজকের এই গল্পটি লিখেছি তা হলো, হঠাৎ একটি গ্রামের হত্যাকান্ডকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এ সময় কেও যাচ্ছে হাসপাতালে আবার কেউ রওনা হয়েছে যেখানে হত্যা হয়েছে সেখানে। এদিকে গ্রামের সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ডকে ঘিরে এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও চোখে পড়ার মতো। গভীর রাত চারিদিকে ধুধু অন্ধকার। পরিবেশ টা থমথমে? গাঁ ছমছম করছে। অন্যদিকে মুহূর্তেই হত্যায় অভিযুক্তরা পালিয়ে যায় ও তাদের বাসায় থাকা সবাই তাদের নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দূরে সরে যান। এরই মধ্যে বিক্ষুদ্ধ জনতা হত্যার অভিযোগে অভিযুক্তদের কয়েকটি বাড়িতে আগুন দিয়েছে। রাত হলেও কিছুটা দূর থেকে স্পৃষ্ট দেখা যাচ্ছে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। সাথে শোনা যাচ্ছে চিৎকার আমার সব পুড়ে গেল পানি দাও আমাকে বাঁচাও। এসময় ঘটনাস্থলের কিছুটা দূরেই ডিউটিতে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেখানেই ছিলো জেলা গোয়েন্দা ডিবি পুলিশের একটি টিম রাতে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে। চোঁখে পড়া মাত্রই ডিবির এস আই বেনু রায় বলে উঠলো, সবাই চলো ওখানে গিয়ে দেখি আশপাশের লোকজনের যেন কোন ক্ষতি না হয়। ঠিক তখনই ডিবি ও পুলিশ ঐ স্থানে যেতেই চোঁখে পড়ে দাও দাও করে আগুন জ্বলছে ঘরে সেখানেই শিশু বাচ্চা সহ এক মায়ের আর্তচিৎকার হাও মাও করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন আমাদের সব পুরে ছাই হয়ে গেল কেও একটু আগুন নিভিয়ে দাও। তখনই ডিবি পুলিশের এস আই বেনু রায়, শিশু বাচ্চাকে একজন ডিবি সদস্যের কোলে তুলে দেন এবং বাচ্চার মাকে তার ঘরে গিয়ে ঘরে নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ কাগজাদীসহ অর্থ নিয়ে বাহিরে আসতে বলে এবং বলতে থাকে আমরা আপনার বাড়ির আগুন নেভাচ্ছি। এসময় আগুন জলা অবস্থায় ডিবির টিম বাসার ভেতরে প্রবেশ করতেই চোঁখে পড়লো গোয়ালে কয়েতটি গরু ও বাছুর বাঁধা অবস্থায় আগুন জ্বলছে পাশে। অবলা পশু গুলো যেন আগুনে পুড়ে মারা না যায় সেজন্য বেনু রায় তার সহকর্মীদের সহযোগিতায় সেগুলো নিরাপদ স্থানে পাঠায়। মুহূর্তেই চারিদিকে আগুন ছড়িয়ে পরে। এসময় চিৎকারের সহিত বেনু রায় তার সহকর্মীদের বলেছেন তাঁরাতাতি আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে এদের সাথে আশপাশের সব কিছু পুঁড়ে যাবে। পানির ব্যবস্থা করো পানি দাও পানি দাও বলছে এবং নিজেই বালতির ভেতর থেকে পানি নিয়ে আগুন নেভাতে থাকে। বারবার চিৎকার করে সহকর্মীদের বললেন কোনভাবেই যেন এ আগুন অন্যত্রে না যায়। ঠিক তখনই আমার চোঁখে পড়ে ওই বাসায় বৈদ্যুতিক লাইন চালু। এ সময় ডিবি পুলিশের সদস্যরা আগুন নেভাতে এতটাই ব্যাস্ত ছিল যে বৈদ্যুতিক লাইন চালু আছে এবং আশেপাশে বৈদ্যুতিক তার মাটিতে পড়ে আছে সেদিকে তাদের খেয়ালই ছিল না। এ সময় আমি নিজে তাদের বলার পর সতর্কতার সহিত বেনু রায় তার ওয়ারলেস সেটে বিদ্যুৎ লাইন অফ করতে বলতে থাকেন। তখই বেনু রায় আমাকে দেখে চিৎকার করে বলতে থাকেন ভাই আপনি আমাদের একটু পানি দিয়ে সহযোগিতা করুন, এবং সকলকে বলুন আমরা পুলিশের লোক আপনারা আসুন এবং আপনাদের মালামাল রক্ষা করুন। পরে সকল সহকর্মীদের সহযোগিতায় প্রায় /৩০/৪০ মিনিট পানি দিয়ে আগুন নেভাতে থাকে। এক পর্যায়ে একটি বাড়িতেই আগুন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এদিকে ফাঁয়ার সার্ভিসের কর্মীরাও পাবনা থেকে ঘটনাস্থলের উদ্দেশে রওনা হয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছালে সবাই মিলে আগুন নেভাতে সক্ষম হয়। ততক্ষণে আশেপাশের বাড়ির লোকজন তাদের বাড়িতে এগিয়ে আসেন। তখন এস আই বেনু রায়কে বলতে শোনা যায় আমরা আগুন নিভিয়ে দিয়েছি আপনারা সবাই দেখুন কোন মালামাল লুট হয়েছে কিনা। এ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয়রা বেনু রায় এর এই ভূমিকাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। আসলে কে এই বেনু রায়, যে কিনা সাধারণ মানুষের সমস্যায় পাশে দাঁড়ায়। অসহায় মানুষ দেখলে তার খোঁজ খবর নেন। নিজের সাধ্যমত সাহায্যের চেষ্টা করেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ পুলিশে চাকরি হয় এই বেনু রায়ের। তিনি সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল থানার সন্ধানী আবাসিক এলাকার পরিমল রায়ের সন্তান। এস আই নিরস্ত্র বেনু রায় (পিপিএম) ২০২০ সালে পাবনায় জেলা গোয়েন্দা পুলিশে যোগদান করেন। এরপর থেকে পাবনার বিভিন্ন জায়গায়, মাদক ও অস্ত্র উদ্ধার সহ চোরাকারবারি ধরা এবং পাবনা জেলার চাঞ্চল্যকর হত্যাকান্ড ও অপহরণ সংঘটিত তার অধিকাংশ উদঘাটন করেছেন এস আই বেনু রায় তার সহকর্মীদের নিয়ে। পাবনায় যোগদান করার আগে সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় ছয় বছর জেলা গোয়েন্দা ডিবি পুলিশে কর্মরত ছিলেন। ইতি মধ্যেই এস আই বেনু রায়, রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক পেয়েছেন । পাবনায় ডিবিতে কর্মরত অবস্থায়, ক্লোলেস মামলা ডিটেক্ট, অবৈধ আগ্নেয়স্ত্র উদ্ধারসহ আইন শৃংখলা রক্ষায় নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ফলস্বরুপ স্বীকৃতি হিসেবে এস আই বেনু রায়ের রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক (পিপিএম) সাহসিকতা, অর্জন করেছেন। গত ২৯ এপ্রিল ২০২৫ ইং তারিখে অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস পুলিশ সার্ভিসের কৃতি সদস্যদেরকে সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক সাহসিকতা ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক সাহসিকতা এবং কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ পদক সেবা ও রাষ্ট্রপতি পুলিশ পদক সেবা প্রদান করেন। এ বিষয়ে এস আই বেনু রায়ের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, মানুষের বিপদের সময় যে পাশে থাকে সেই প্রকৃত বন্ধু। আমি কোনো জনপ্রতিনিধি বা মহৎ ব্যক্তি হতে চাই না। আমি চাই মানুষের দুঃসময়ের বন্ধু হতে। সব সময় চেষ্টা করি নিজের সাধ্য অনুযায়ী সমাজের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে। আমি মনে করি যে, মানুষের সেবা করার সদিচ্ছা থাকলে সর্বোচ্চ সুযোগ পুলিশ বাহিনীতে আছে। এজন্য কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি বা শিল্পপতি হওয়ার প্রয়োজন হয়না। শুধু সদিচাছা টুকুই প্রয়োজন। আমার কর্মজীবনে যে কোন অভিযানে গিয়ে সেটুকুই উপলব্ধি করেছি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করি। ভালো কাজের শহীত সৃষ্টিকর্তা যেমন সহায়ক হয় তেমনি সাধারণ মানুষের সহযোগিতা এবং ভালোবাসা পাওয়া যায়। আমার চাকরি জীবনে এমন কোন রেকর্ড নেই যে? আমার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা যেই মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছে আমাকে সেটি উদঘাটন করতে পারিনি। নিজের সদিচ্ছায় এবং সৃষ্টিকর্তার সহায়তায় ও সাধারণ মানুষের ভালোবাসায় প্রতিটি কাজেই আমি সফল হয়েছি। সেক্ষেত্রে ডিপার্টমেন্ট থেকে যদি এ কাজের জন্য আরও বেশি উৎসাহ পাই তাহলে আশা করি আমার এই সকল কর্মকান্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের সুনাম আরও অনেক বৃদ্ধি পাবে। এ বিষয়ে পাবনা জেলা গোয়েন্দা ডিবি পুলিশের ওসি মোঃ রাশিদুল ইসলাম জানান, জেলা গোয়েন্দা ডিবির এস আই বেনু রায় একজন মানবিক অফিসার। সে অপরাধিকে বোঝাতে সক্ষম হয় এবং অপরাধী নিজেই বোঝে যে সে আসলেই অপরাধ করেছে। আমরা জনগণের বন্ধু, তবে বেনু রায় দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে মানবিক ও গ্রহণযোগ্য আচরণ, সততা, নিষ্ঠার সাথে যে কোন অপরাধ নিয়ন্ত্রণে উদ্ধর্তণ কর্মকর্তাদের অনুমতিক্রমে কার্যকর পদক্ষেপ নেন। আমি বেনু রায়ের উত্তরোত্তর সাফল্য ও সার্বিক মঙ্গল কামনা করছি। এদিকে সচেতন মহল মনে করছেন, পুলিশ সদস্য হয়েও সমাজের অসহায় ও হতদরিদ্র মানুষের কল্যাণে এভাবে নিজেকে নিয়োজিত রাখা মানবতার অনন্য দৃষ্টান্ত। যার ফলে বাংলাদেশ পুলিশের ভাবমূর্তি অক্ষন্নু থাকবে।