রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৭:৪৩ পূর্বাহ্ন

ই-পেপার

বালিশ দুর্নীতি আর ছাগল দুর্নীতিতে অভিন্নতা নাই

চলনবিলের আলো ডেস্ক:
আপডেট সময়: মঙ্গলবার, ২ জুলাই, ২০২৪, ৬:০৯ অপরাহ্ণ

আমরা এত লজ্জাহীন! ঘুষ আমার অধিকার মনে করি। বালিশ দুর্নীতি,  ছাগল দুর্নীতি! বেশ বাহারি নাম। দুর্নীতি আমাদের দেশে এখন ডাল-ভাত। দুর্নীতি সমাজের প্রতিটি স্তরে,  প্রতিটি শিরা , উপশিরায় বিশাল আবরণ তৈরী করে ফেলেছে। দুর্নীতি এখন সুনীতির আসনে।দীর্ঘ ৫৩ বছরের দুর্নীতির আগ্রাসনে  দেশের সর্বত্রই মরিচার শক্ত আবরণ পরেছে । এই দুর্নীতি নামক মরিচাকে হঠাৎ করে একেরাবে পরিস্কার করা অকল্পনীয় ও দুঃসাধ্য । এর জন্য দরকার বিবেক নামক শিরিশ কাগজ যা দিয়ে আস্তে আস্তে ঘষে সমাজ থেকে দুর্নীতিকে পরিস্কার করা যাবে । স্বাধীনতার পর থেকে স্বাধীন মানচিত্রেকে নিয়ে টানা- হেঁচড়া করতেছে দুর্নীতিবাজরা।

  এক অশুভশক্তি দুর্নীতি, এই দুর্নীতির বেড়াজালে দেশ আটকা পরে গেছে । স্বাধীনতার এত বছর পরও এ দেশের দুর্নীতি বন্ধ তো দূরের কথা,  দুর্নীতি পরিমাণ কমাতেও ব্যর্থ হয়েছে প্রতিটি সরকার ।
” চোরের বাড়ীতে নাকি দালান হয়না। ”  কিন্তু  দুর্নীতিবাজ চোরদের বাড়ীতে অট্রালিকা কেন ?
সব ধরনের দুর্নীতি সমাজে সমান ক্ষতি সাধন করেনা। যেমন – একজন গ্রাম্য মাতাব্বর কিছু টাকা নিয়ে দোষীকে রেহাই দেওয়ার দুর্নীতি আর রডের পরিবর্তে বাঁশ দিয়ে সরকারী বাড়ী তৈরী করার দুর্নীতিকে এক পাল্লায় উঠালে ভূল হবে ।বনভূমি ধ্বংস করার দুর্নীতি আর ঘুষ দুর্নীতি এক রকম না । আবার তিতাসগ্যাসের মিটার রিডার দুর্নীতি করে ১১ তলা বাড়ী তৈরী করার দুর্নীতির
সাথে, পুলিশের একজন কর্মকর্তার হাজার কোটি কোটি, সরকারী ক্রয় কমিটির দুর্নীতি এক অভিন্ন জিনিস। সকল ধরনের দুর্নীতি সমাজ বা রাষ্ট্রের কাঠামোতে কম বেশী আঘাত করে । আর বড় দুর্নীতি গুলি রাষ্ট্রের মেরুদণ্ডকে ভেঙ্গে দেয় । তাই বড় ধরনের দুর্নীতির বিরোদ্ধে সরকারকে জরুরী
অবস্থান জারী করতে হবে।

         দুর্নীতিবাজরা দেশ ও জাতির শক্রু । রাষ্ট্রকে আগে চিহ্নিত করতে হবে  কোথায়,  কোন খাতে বেশী দুর্নীতি হচ্ছে। প্রতি বছরেই সেবাখাত গুলো দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেবাখাত গুলো মধ্যে হয়তোবা বছরান্তে সূচনের উঠানামা হয়।
সেবাধর্মী  খাত গুলোতে মানুষের চলাচল বেশী থাকে তাই দুর্নীতিও বেশী হয় । দেশের এক বছরের দুর্নীতির অর্থ দিয়ে পদ্মা সেতু তৈরী করা সম্বব । সেবা খাতে বছরে দুর্নীতি হয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা, তারমধ্যে ঘুষ দুর্নীতি হয় ৯ হাজার কোটি টাকা ।ঘুষ দুর্নীতি হয় বাজেটের ৩.৭ শতাংশ জিডিপির  ০.৬ শতাংশ । উচ্চ আয়ের তুলনায় নিন্ম আয়ের মানুষের ওপর দুর্নীতি বেশী হয়।

    বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্হ দেশ গুলোর তালিকায়
আমাদের দেশের সূচকের অবনতি, এটা নতুন কিছু না। তাতে জাতি কিংবা রাষ্ট্র লজ্জাবোধ করে না। বাংলাদেশে দুর্নীতি বৃদ্ধির প্রধান কারন,  স্বাধীনতার পর প্রতিটি সরকার দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে অথবা দুর্নীতিবাজদের অর্থের বিনিময়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে ।রাষ্ট্র দুর্নীতিবাজদের
দুর্নীতির মুখোশ খুলতে ব্যর্থ।এতে করে দেশ দুর্নীতির চোরাবালিতে ডুবতেছে ।

    দেশ ও সমাজকে একেবারে  দুর্নীতি মুক্ত করা অদূর ভবিষ্যতেও সম্বব নয় । কিন্তু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করলে দুর্নীতি সহনশীল মাত্রায় আনা সম্ভব । যেখানে সারা বিশ্ব আজ দুর্নীতির
বিষাক্ত ছোবলে বিষগ্রস্থ । আর এই সব দুর্নীতিবাজরা পৃথিবীতেই বসবাস করে । প্রকাশ্যে সবাই তাদের বিরোদ্ধে কিন্তু অন্ধকারে দেয় সবুজ সংকেত । প্রতি বছর সারা বিশ্ব ২.৬ ট্রিলিয়ন ডলার লুপাট হয় ।  এরমধ্য ঘুষ দুর্নীতি হয় ১ ট্রিলিয়ন ডলার । বিশ্বময় দুর্নীতির বিরোদ্ধে প্রচার- প্রচারণার কোন ঘাটতি নেই,  কিন্তু দুর্নীতিবাজরা থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

   আমরা আমাদের দেশের কথা ভাবি। বর্তমান সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। বেনজির, মতিউর, ফয়সাল এর চেয়েও বড় দুর্নীতিবাজদের মুখোশ কে উন্মোচন করবে?
একটা জরিপে দেখা গেছে মাত্র ৭.৫ শতাংশ মানুষ দুদকে  ( দুর্নীতি দমন কমিশন )  অভিযোগ দাখিল করেন ।তাও তারা এই ভরসায় অভিযোগ জমা দেন,  যদি লাইগেয়া যায় । যুগ যুগ ধরে মানুষ দুদকের প্রতি আস্থাহীনতায় ভুগছে। এই আস্থার জায়গাটা ফিরিয়ে আনা হবে দুদকের  বড় চ্যালেঞ্জ।  বর্তমান সরকারের সদ ইচ্ছায় দুদকের কার্যক্রম এখন মানুষের মনে ক্ষীণ আস্থার আলো সঞ্চালন করলেও, বন দখল, ছাগল দুর্নীতি, ফয়সাল কান্ডের মতো আলোচিত দুর্নীতি দুদককে    অর্ধ উলঙ্গ করে দিয়েছে। সরকার দুদকের আইনি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষে মামলা ছাড়াই দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার করতে পারবে এই ক্ষমতা দুদককে দিয়েছে। প্রতিটি স্পর্শকাতর আইনের অপব্যবহার হয়। তাই দুদককে প্রথমে চিনি খাওয়া ছাড়তে হবে। ঘুষ দুর্নীতি থেকে দুদকের প্রতিটি কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে মুক্ত করতে হবে । নতুবা এই আইনের অপব্যবহার হবেই ।

 বাংলাদেশ প্রতিটি সরকার  দেশ থেকে দুর্নীতি দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারন প্রতিটি  সরকার দুর্নীতিবাজদের প্রশ্রয় দিয়েছে অথবা দুর্নীতিবাজদের সহযোগীতায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে । দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হলে, দুর্নীতি মুক্ত রাজনৈতিক দল চাই, দুর্নীতি মুক্ত নেতা চাই, দুর্নীতি মুক্ত সরকার চাই , স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন চাই । প্রতিটা জরিপে উঠে এসেছে সরকারী সেবাধর্মী খাতে দুর্নীতি হয় সবচেয়ে বেশী । তাহলে দুর্নীতির ঐসব চিহ্নিত সরকারী খাত গুলোতে দুর্নীতির বন্ধের উদ্যোগ নিতে হবে।  এদের দুর্নীতির মূখগুলোকে সীলগালা করে দিতে পারলে দুর্নীতি পথ অনেকটাই রুদ্ধ হয়ে যাবে। এই সব খাত গুলোকে যথা সম্বব প্রযুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।  তবে দরকার সরকার ও দুদকের সমন্বয়ে কার্যকরী অভিযান । সরকারী / আধা সরকারী অফিস গুলো থেকে দুর্নীতি দূর করতে পারলে, জাতি দুর্নীতির অভিশাপ থেকে  অনেকাংশেই রেহাই পাবে।  আইনের দোহাই দিয়ে অথবা গ্রেফতার করে  সরকারী অফিস গুলো থেকে সাময়িক ভাবে দুর্নীতির বিরোদ্ধে সুফল পাওয়া যেতে পারে।  কিন্তু কাঙ্খিত ও দীর্ঘস্হায়ী সুফল পেলে হলে শাসনের পাশাপাশি কাউন্সিলের মাধ্যমে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও তাদের বিবেক জাগ্রত করতে হবে।

  দুর্নীতি রোধে দুদককে প্রকৃত পক্ষে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিয়ে শক্তিশালী একটা দুদক গঠন করতে হবে। দুদকের দুর্নীতি বিরোধী  কার্যক্রম প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিস্তৃত  করতে হবে। প্রতিটি ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের পাঠ্যসূচীতে দুর্নীতি বিরোধী লেখা অন্তর্ভূত করতে হবে। শহরে বসে থাকলে চলবে না। দুর্নীতি এখন সমাজের শিকড় থেকে শিকড়ে বিস্তৃত । দুর্নীতির মূল ও প্রধান উৎস গুলোর মুখ বন্ধ করা অতি জরুরী ।  যেমন – নিয়োগ বাণিজ্য, বদলী বাণিজ্য, পদোন্নতি বাণিজ্য,  ঘুষ বাণিজ্য  ইত্যাদি । লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকুরী নিলে তো,  ঘুষ না খাইলে তো বেহুশ  হবেই। দুর্নীতি সমাজের একটা পঁচনশীল ব্যাধি। তাই দুর্নীতির বড় প্রতিষেধক হচ্ছে সামাজিক আন্দোলন আর সরকারের সদ ইচ্ছা । রাজনৈতিক জনসভা আর ধর্মীয় জনসভা,  সব সভাতেই বক্তাগণ দুর্নীতির বিরোদ্ধে জড়ালো বক্তব্য দিতে হবে।  নইলে দুর্নীতিবাজরা মুখের ভাষা কেরে নিবে ।

লেখক ও কলামিস্ট  /  
মোঃ সাইদুর রহমান
নান্দাইল, ময়মনসিংহ।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন
এক ক্লিকে বিভাগের খবর