আমাদের মধ্যে বহু উদ্ভিদবিলাসী আছেন- তারা উদ্ভিদকে ভালোবাসেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ভালো থাকাটি যেমন আপনাদের কাছে প্রত্যাশিত, হয়তো সেভাবেই চান- আপনাদের যত্নে গড়া গাছটিও ভালো থাকুক। অশেষ মমতায় আপনারা হয়তো সেগুলো বপন করেছেন, রোপণ করেছেন। কিন্তু এদের কোন সমস্যায় কিংবা এর সাধারণ যত্ন নিতে কি কখনো হোমিওপ্যাথিক ঔষধ ব্যবহার করে দেখেছেন? নিশ্চিত থাকুন, হোমিওপ্যাথি আপনার বৃক্ষটিরও সবচাইতে উপযুক্ত যত্ন নিতে সক্ষম।
যেহেতু এটি মাটিতে জন্মানো এবং মাটির সাথে ওতপ্রোত বন্ধনে থাকা প্রাণ। এ কারণে এর সমৃদ্ধির জন্য মাটি ও সেইসাথে পর্যাপ্ত সূর্যালোক ও পানির প্রয়োজন হয়। যদি এগুলোর কোনটির অভাব পড়ে- তারা রোগাক্রান্ত হয়, পোকামাকড় কিংবা আশে পাশে থাকা উদ্ভিদ দ্বারা আক্রান্ত হয়। অন্য আগাছাগুলোও তাদের জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। তাদের স্বাস্থ্যের জন্য যথাযথ আবহাওয়া ও পারিপার্শ্বিকতা অপরিহার্য। কিন্তু এগুলোর পর্যাপ্ত সরবরাহ সত্ত্বেও যদি বৃক্ষটি আক্রান্ত হয়, তাহলে তার স্বাস্থ্য পুনরূদ্ধার করতে সবচেয়ে উপযোগী উপায়ের অন্যতম হচ্ছে হোমিওপ্যাথি। কিন্তু যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, আমাদের দেশে এর যথাযথ চর্চার অভাবের দরুন- তা আমাদের কাছে অদ্ভুত, বিস্ময়কর, আজগুবি মনে হতে পারে। কিন্তু প্রতিটি নতুন পদক্ষেপই প্রথমে আজগুবিই থাকে কিন্তু আমাদের দেশের বাইরে এখন অনেকেই এর বহুল ব্যবহার ও সফলতার প্রমাণ উপস্থিত করছে।
কিন্তু সে যাই হোক, উদ্ভিদে এর সফল প্রয়োগ করতে গেলে কেবল হোমিওপ্যাথিক ঔষধ হলেই তো হবে না। তার যথাযথ প্রয়োগও জানতে হবে। আর এজন্য অন্ততপক্ষে ন্যূনতম পর্যবেক্ষণেরও প্রয়োজন হয়। পরিপোষক কারণ হিসাবে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও আবহাওয়াকে বিবেচনা করার পর- একটি উদ্ভিদকে চিকিৎসা করতে গেলে প্রথমে নিচের প্রশ্নগুলোর উত্তর সাজিয়ে নিতে হবে-
১. উদ্ভিদটির ঠিক কি সমস্যা হচ্ছে?
২. কি কি পরিবর্তন বা লক্ষণের কারণে আপনি সমস্যাটা বুঝতে পারলেন?
৩. কবে থেকে এই সমস্যা বা সমস্যাগুলোর সূত্রপাত?
৪. লক্ষণগুলো কিভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে? (যথাসম্ভব বিস্তারিত বর্ণনা)
৫. লক্ষণগুলো উদ্ভিদের কোন কোন অংশে প্রকাশ পেয়েছে?
৬. কোন কিছু লক্ষণগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে, বাড়ায় বা কমায়?
এবার হোমিওপ্যাথিক ঔষধগুলো নিয়ে ভেবে দেখুন। উক্ত সমস্যার সাথে কোন ঔষধগুলোর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। হ্যা, এই চিন্তাপদ্ধতি নতুন বলে- অনেকেই এখনো হয়তো পদ্ধতিটি সম্বন্ধে অস্পষ্ট থাকতে পারেন। মূলত পেশাগত দক্ষতা নিয়ে কাজটি করতে গেলে, বোটানি- উদ্ভিদতত্ত্ব ও উদ্ভিদ রোগবিদ্যায় ন্যূনতম জ্ঞানটুকু লাগবে। আমাদের অনেক হোমিওপ্যাথেরই তা আছে এবং তাদের জন্য বিস্তারিত আলোচনা আমি ভবিষ্যতে অন্য আরেকদিন করবো।
আমি আজকের আলোচনায় এ সম্বন্ধে একটি সাধারণ চিন্তাপদ্ধতি নিচে পেশ করছি – যাতে এ ব্যাপারে সবাই কিছুটা ধারণা গ্রহণ করতে পারে ও চিন্তা করার সুযোগ পায়। আর কাজটি আমি করছি, অতি সাধারণ কিছু উদাহরণের মাধ্যমে-
১. গরমের দিনে আপনি চটপট একটি গাছকে ছেঁটে দিয়েছেন। আর এরপরই গাছটি দুর্বল হয়ে কিছুটা নেতিয়ে পড়েছে। সন্দেহ নেই, কিছুক্ষণ আগেই আপনি গাছটিকে যথেষ্ঠ পরিমাণ আঘাত করেছেন। একডোজ আর্নিকা – ২০০ পানিতে গুলিয়ে গাছের শেকড়ের মাটিতে দিন। ছেঁটে যাওয়া স্থানগুলোতে ক্যালেন্ডুলা – ৩০ ছিটিয়ে বা স্প্রে করে দিন।
২. আপনার সাধের গোলাপ গাছের কান্ডে, নতুন কুঁড়িতে, বা ফুলে হয়তো এফাইডগুলো (Aphids- জাবপোকা) আসন গেঁড়েছে এবং তার প্রাণশক্তি শুষে নিচ্ছে। প্রথমে চেক করুন পানি নিষ্কাষণে বিঘ্ন, অতিরিক্ত সারপ্রয়োগ- এরকম কোন পরিপোষক কারণ আছে কিনা। থাকলে তা দূর করুন ও সিমিসিফিউগা – ৩০ প্রয়োজনমতো প্রয়োগ করুন।
৩. আপনার অতি-যত্নের অর্কিডটিকে হয়তো আপনি রেখে চলে গিয়েছেন কয়েকদিনের জন্য বাসার বাইরে। ফিরে এসে দেখলেন এ কয়দিনের অযত্নে তা নেতিয়ে পড়েছে। এবার তার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনাস্বরূপ ইগ্নেশিয়া – ৩০ একটি ডোজ দিয়ে একটু যত্ন নিন, তার মুখে হাসি ফুটে উঠবে।
৪. আর্দ্র, উষ্ণ আবহাওয়ায় আপনার টমেটোগুলোর তলায় ধূসর হয় পচে যাচ্ছে? নেট্রাম সালফ – ৩০ দিন। তারা বেঁচে যাবে।
৫. আপনার উঠোনের ঘাসগুলো অপুষ্টিতে ভুগছে বলে মনে হচ্ছে? শুকনো মাটিতে তারা ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারছেনা বলে মনে হচ্ছে? আরো কিছু ঘাসের বীজ দিয়ে সেখানে পানিতে সাইলিশিয়া – ২০০ মিশিয়ে ভিজিয়ে দিন। ভিন্ন চিত্র দেখতে পাবেন। এখনো সন্তুষ্ট না হলে- দেড় মাস পর আবারও তা এই দ্রবণ তৈরি করে তা দিয়ে ভিজিয়ে দিন।
কিভাবে ঔষধ দ্রবণ প্রস্তুত করবেন-
উদ্ভিদের সমস্যা জানার পর ও তার কারণ বুঝে নেবার পর যে কাজটি গুরুত্বপূ্র্ণ, তা হচ্ছে- ঔষধের দ্রবণ তৈরি করা। আসলে এই কাজটিই সবচেয়ে সহজ। ১৫০ মিলির বোতলে পানি নিয়ে, কাঙ্ক্ষিত ঔষধের ৬-৮টি গ্লোবিউলস দিন এবং তা পানিতে পুরোপুরি মিশে না যাওয়া পর্যন্ত জোরে জোরে ঝাঁকান। এই দ্রবণটি আপনার প্রয়োজন অনুযায়ী আরো বেশি পরিমাণ পানিতে ঢেলে নিতে পারেন।
উদ্ভিদের চিকিৎসায় বেশিরভাগ সময় ৩০ বা ২০০ শক্তির পোটেন্সিই ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তাকে শক্তিপ্রদান, উর্বর ও বেশি ফল-ফুলদায়ক করার জন্য ৬X পোটেন্সিও ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে, যেখানে Helix tosta ঔষধটি দেবার প্রয়োজন পড়ে সেখানে ৬X পোটেন্সিতেই দেয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক ঔষধের কার্যকারিতার প্রমাণ- এর জন্মের পরপরই পাওয়া গেলেও। এর ফলপ্রসূ গবেষণা ও ব্যবহার শুরু হয়েছে বহু পরে। ডারউইন এ নিয়ে সুবিস্তৃত সফল গবেষণা করে গেলেও তা প্রকাশ করে যেতে পারেননি। কাজেই, উদ্ভিদের হোমিওপ্যাথির পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার ও প্রয়োগপদ্ধতি আসলে এখনো ক্রমাগত সমৃদ্ধ হচ্ছে। তবে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, হোমিওপ্যাথির ব্যবহার আপনার উদ্ভিদের মধ্যে কখনোই কোন বাজে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। যেহেতু এটি নিরাপদ ও এর খরচও অত্যল্প, কাজেই এর ব্যবহারের মাধ্যমে এ ব্যাপারে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জন করে যেমন গবেষণাধর্মী আনন্দে সমৃদ্ধ হতে পারেন, অন্যদিকে প্রকৃতিকে প্রকৃতির মাধ্যমে চিকিৎসা করে ও তার বিস্ময়কর ফল প্রত্যক্ষ করে হতে পারেন প্রশান্তচিত্ত। কাজেই, এবার আমি আপনাদের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার সুসংবাদ প্রাপ্তির প্রত্যাশায় নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে পারি।
লেখকঃ
ডা.মো.শাহীন মাহমুদ
প্রভাষক
মডেল হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,গাজীপুর।
#চলনবিলের আলো / আপন