যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর শহর থেকে অভয়নগর পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার অংশ পুনর্নির্মাণের কাজ শেষ হয় ২০২২ সালের জুনে। প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩৪৮ কোটি টাকা। সড়কটি তিন বছর টেকসই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এক মাস না যেতেই বিভিন্ন স্থানে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। ফলে জনবহুল ওই রাস্তা নির্মাণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোটি-কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে বলে একটি সূত্রে জানা গেছে। অন্যদিকে যশোর- খুলনা রাস্তা নির্মাণের বিষয়ে প্রকৌশলের ভাষায় এ সমস্যাকে ‘রাটিং’ বলে। এক বছরের মধ্যে রাটিংয়ের কারণে প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকা চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। শেষে গত জুনে সড়কটি সংস্কারে ১৬০ কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব পাঠিয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করায় এক মাসও টেকেনি সড়কটি। তবে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও সওজ দায় চাপিয়েছে ভারী যানবাহনের ওপর। এদিকে যে ঠিকাদারি দুই প্রতিষ্ঠান সড়কটি পুনর্নির্মাণের কাজ পেয়েছিল, তারাই আবার সংস্কারের কাজ পেয়েছে। এ ব্যাপারে যশোর বাস মালিক সমিতির পক্ষ থেকে সূত্রে জানা গেছে, ‘নতুন হওয়া সড়কে এক মাসের মধ্যে এমন ফুলেফেঁপে ওঠা কখনো দেখিনি। আগে ঘষেমেজে আঁকাবাঁকা ঠিক করা হয়েছিল। এখন ঢালাইয়ের কাজ করছে। বছরের পর বছর এই সড়কে কাজ করায় প্রচণ্ড যানজট সৃষ্টি হয়। সওজের সঙ্গে ভাগাভাগি করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজে অনিয়ম করায় এমনটি হয়েছে। সরকার শত শত কোটি টাকা খরচ করলেও সড়কের মান উন্নয়ন করতে পারেনি।’ সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র বলছে, যশোর-খুলনা মহাসড়কের যশোর শহরের পালবাড়ী মোড় থেকে অভয়নগরের রাজঘাট পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার সড়কের নির্মাণকাজের অনুমোদন মেলে ২০১৭ সালে। টেন্ডারসহ সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের মে মাসে। এর মধ্যে পদ্মবিলা, রাজঘাট হয়ে চেঙ্গুটিয়া পর্যন্ত ১৯ কিলোমিটারের কাজ পায় ‘তমা কনস্ট্রাকশন’। বাকি ১৯ কিলোমিটারের কাজ পায় ‘মাহবুব ব্রাদার্স’। দুটি প্যাকেজে মোট ৩২১ কোটি টাকা ব্যয়ের এই প্রকল্প শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের জুনে। সূত্র বলেছে, কার্যতালিকা অনুযায়ী সড়কটির আয়ুষ্কাল ছিল তিন বছর। অর্থাৎ সময়মতো কাজ করলে শেষ হতো ২০২৩ সালের জুনে। কিন্তু করোনা ও বিরূপ আবহাওয়ার কারণে প্রকল্পের মেয়াদ করা হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর। বর্ধিত সে সময়েও কাজ শেষ হয়নি। পরে আবার প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এতে ব্যয় ২৭ কোটি টাকা বেড়ে হয় ৩৪৮ কোটি টাকা। কিন্তু সড়কটি সওজকে বুঝিয়ে দেওয়ার এক মাসের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ফুলেফেঁপে উঠতে শুরু করে। এক বছরের মধ্যে সড়কের প্রায় ১৬ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে রাটিংয়ের কারণে সৃষ্টি হয় নানা গর্ত। সমস্যা সমাধানে ফের পিচ ঢালাই করেও ফল মেলেনি। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যশোর-খুলনা মহাসড়কের পালবাড়ী থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে রাটিং রয়েছে। যশোর সদরের বসুন্দিয়া, প্রেমবাগ, চেঙ্গুটিয়া, ভাঙ্গা গেট, রূপদিয়া, মুড়লী, পদ্মবিলা এবং অভয়নগরের নওয়াপাড়া এলাকায় রাটিং বেশি। ফুলেফেঁপে ওঠা সড়কে চলাচল করতে গিয়ে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। স্থানীয় একাধিক ব্যক্তিরা জাবান ‘এই সড়কটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নওয়াপাড়া নৌবন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহন হয়। যশোর-খুলনা মহাসড়কে রাটিংয়ের কারণে প্রায়ই পণ্যবোঝাই ট্রাক উল্টে যায়। নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে রাস্তা নির্মাণের কারণে এমন অবস্থা।’ একজন ট্রাকচালক জানান, ‘সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বসুন্দিয়া থেকে নওয়াপাড়া রাজঘাট পর্যন্ত। কিছু কিছু জায়গায় বিটুমিন উঠে গেছে। ভারী পণ্য নিয়ে যাতায়াতের সময় ট্রাক হেলেদুলে চলে।’ সড়ক ও জনপথের তথ্যমতে, মহাসড়কের রাটিং সংস্কারের জন্য পিচের রাস্তার ওপর কংক্রিট রাস্তা নির্মাণে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে গত জুনে প্রস্তাব পাঠায় সওজ। ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ১৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ কিলোমিটার রাস্তা প্রথম পর্যায়ে কংক্রিট বা ঢালাই রাস্তা করার জন্য নির্দেশনা পেয়েছে সওজ। এখন সেই কাজ চলছে। কাজ করছে সেই ‘মাহবুব ব্রাদার্স’ ও ‘তমা কনস্ট্রাকশন’ই। কিন্তু চেঙ্গুটিয়া থেকে বেঙ্গলগেট পযন্ত কিছু কিছু জাগা ঢালাই রাস্তা নির্মাণ করলেও বর্তমানে রাস্তা ঢালাই কাজ তিন মাসব্যাপি বন্ধ রয়েছে। সূত্র বলছে আওয়ামী লীগ সরকার পতন হওয়ার কারণে রাস্তার কাজ বন্ধ রয়েছে।
প্রেমবাগ এলাকার একাধিক ইজিবাইকচালকরা অভিযোগ করে জানান, ‘আমাদের খুব সমস্যা। রাস্তা উঁচু নিচু খানাখন্দভরা গাড়ি চালাতে পারিনা একটু অসাবধানতা হলেই গাড়ি উল্টে পড়ে, যে কারণে অনেক ঝুঁকি নিয়ে গাড়ি চালাতে হয়। এক লেন থেকে অন্য লেনে যেতে গেলে মাঝখানে উঁচু। প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে।’একজন পথচারী মোকছেদ আলী বলেন, ‘মোটরসাইকেল চালাই। এই সড়কে ঝুঁকিতে থাকি। ছোট যানবাহনগুলো প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে। এত দ্রুত সড়ক কেন বেহাল হলো বুঝতে পারি না। অন্য সড়কগুলোতেও একই যানবাহন চলছে, সেগুলো তো এমন হচ্ছে না।’ এর আগে সড়কের কাজের শুরুতেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। এলাকাবাসীর অভিযোগ, সড়ক উন্নয়নের কাজে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো নিয়মনীতি মানেনি। তারা গোঁজামিল দিয়ে ইচ্ছেমতো কাজ করেছে। ঠিকাদারেরা সড়কের পুরোনো নোনা ধরা ইট-খোয়া তুলে সেটাই আবার ভেঙে গর্তে ব্যবহার করেছেন। এ ছাড়া সড়কটি ৫ ফুট গর্ত করে ভিত তৈরির নির্দেশনা থাকলেও সেই নিয়মও মানেনি। সড়কে নতুন ইট, বালু, খোয়া ব্যবহার না করে খুঁড়ে ওঠানো মালামাল দিয়েই ফের ভরাট করা হয়েছে।
এবিষয়ে বিষয়ে ‘তমা কনস্ট্রাকশন’-এর সাব-ঠিকাদার সৈয়দ তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাজের মান নিয়ে সড়ক বিভাগ ও বুয়েট কোনো প্রশ্ন তুলতে পারেনি। রাস্তার ঢালাই কাজ বন্ধের বিষয়ে তিনি কিছু বলতে পারবেনা বলে জানান, ওই সাব- ঠিকাদার। যশোর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী গোলাম কিবরিয়ার মুঠোফোন একাধিক বার চেষ্টা করেও তার ফোন বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।