টাঙ্গাইলের ভ‚ঞাপুর উপজেলার চরাঞ্চলের ৭০-৮০ ভাগ মানুষ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির সাথে জরিত। প্রকৃতিকে নির্ভর করে বহুকাল ধরে চরাঞ্চলের মানুষ চাষ-আবাদ করে আসছে। চরাঞ্চল নদী বেষ্টটিত হওয়ায় হাজার হাজার পরিবার বহুবার নদী ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। তারা আবার গড়েছেও। ভাঙা গড়ার খেলায় নদী চরাঞ্চলের মানুষদের কাছ থেকে কেড়েও নিয়েছে অনেক আবার চরাঞ্চলের অনেক মানুষ সমৃদ্ধিও হয়েছে কৃষির উপরই নির্ভর করে। কালের পরিক্রমায় কৃষি প্রধান এই চরাঞ্চলে এখন আধুনিক কৃষির বিস্তার হচ্ছে। এখানকার কৃষকরা এখন আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে নানা রকম ফসল ফলাচ্ছে। কৃষি বিভাগের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও সহজ শর্তে ঋণ পেলে এই চরাঞ্চল হতে পারে কৃষি অর্থনীতির সম্ভাবনাময় নতুন দিগন্ত। ভ‚ঞাপুরের চরাঞ্চলে কৃষির এ রকম বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজনীয় সহায়তা পাচ্ছে না, এমনই অভিযোগ চরাঞ্চলের কৃষকদের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কৃষি জমির বিশাল ভান্ডার চরাঞ্চল জুড়ে। উপজেলের গাবসারা ও অর্জুনা ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই চরাঞ্চল। চরাঞ্চলের বহু জমিই বছরে একবার চাষ হয়। বাকি সময় পতিত থাকে। কৃষকদের দাবি সরকারের সহযোগিতা পেলে এসব জমি দু বা ত্রিফসলি করা সম্ভব। ভেজাল বীজ, সার ও কীটনাশক সংকট, সেচের অভাব, প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ না থাকা, গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকা, কৃষি পন্য সঠিক বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা না থাকা, পরিবহন ব্যবস্থা ভাল না হওয়া ইত্যাদি কারণে চরাঞ্চলের কৃষি খাদ এখন হুমকির মুখে ফেলে।
শুষ্ক মৌসুমে চরাঞ্চলের কৃষকরা আলু, সরিষা, খেসারি, মুশারি কলাই, ভ‚ট্টা, বাদাম, গম চাষ করে লাভবান হচ্ছে। সবজি চাষে আগ্রহী কৃষকেরা শীতের আগাম সবজি চাষ করছে। অথচ তাদের জন্য প্রশি¶ণ, প্রয়োজনীয় তথ্য ও বাজার ব্যবস্থার সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট বিভাগের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব অবহেলারও অভিযোগ আছে। মূলত তারা আধুনিক কৃষি স¤প্রসারণে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পায় না। নদী ভাঙনে সর্বস্বহারা মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে অপরিকল্পিতভাবে জনপদ গড়ে তোলে। যার ফলে জমির অপচয় ও আধুনিক কৃষি উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বহু জমি পতিত থাকে। চরাঞ্চলের প্রান্তিক চাষির নিজস্ব জমি নেই। তাদের অদম্য ইচ্ছা শক্তি ও মেধা আছে। তাদের মেধা ও শ্রমকে বিকশিত করে কৃষি খাদে কাজে লাগানো প্রয়োজন। এছাড়া চরাঞ্চলে অসংখ্য কৃষি শ্রমিক রয়েছে, যাদের হাত দিয়ে ৮০ শতাংশ কৃষি কাজ হচ্ছে। তারা অভিজ্ঞতাকে আরো বেশী কাজে লাগানোর নিশ্চয়তা চায়। চায় চরাঞ্চলে কৃষি অর্থনীতির নতুন দিগন্ত গড়তে। চরাঞ্চলের কৃষদের দাবি, পতিত জমিগুলো কৃষি বিভাগের পরামর্শে উন্নত জাতের ফসল চাষ করা। কৃষি বিভাগও বলছে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পতিত জমি চাষাবাদের আওতায় আনতে হবে। অথচ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই।
ভ‚ঞাপুরের চরাঞ্চলে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া তথা পশুসম্পদে সমৃদ্ধ হতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগ সুনজর দিলে পশুদের জন্য চারণ ভ‚মি সৃষ্টি করে চরাঞ্চলে গবাদি পশুর খামার গড়ে তোলা যাবে। এছাড়াও চরাঞ্চলের মানুষ বর্ষা মৌসুমে ও মৌসুম পরবর্তী সময়ে গড়ে ৩-৪ মাস কর্মহীন থাকে। এ কয়েক মাস চরাঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রায় যে বিপর্যয় আসে রা থেকে উত্তরণের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনা নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন চরাঞ্চলের কৃষকেরা।
বিগত কয়েক বছর যাবৎ উপজেলার চরাঞ্চলে ভ‚ট্টা চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অল্প খরছে বেশী ফসল পাওয়ায় ভ‚ট্টা চরাঞ্চলের কৃষিতে বিপ্লব ঘটিয়েছে। অথচ ভ‚ট্টা মারাইয়ের আধুনিক পদ্ধতি না জানায় বিপাকে পড়তে হয় ভ‚ট্টা চাষিদের।
কৃষকরা জানান, ভ‚ট্টার জমিতে সবজি হিসেবে লালশাক, পালংশাক ও ধনে পাতা চাষ করে বাড়তি আয় করা যায়। ভ‚ট্টার দাম আশানুরূপ, ফলনও বেশী। এতে খুশি কৃষকেরা। ইতোমধ্যে ভ‚ট্টা চাষে বদলে গিয়েছে চরাঞ্চলের অনেক কৃষকের জীবনযাত্রার মান। এ কারণে অন্য কৃষকেরা ভ‚ট্টা চাষের দিকে ঝুকে পড়েছেন।
কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর ভ‚ঞাপুরের তথ্য মতে, এবার উপজেলায় বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা ৬ হাজার ৯’শ হেক্টর আবাদ হয়েছে ৭ হাজার ২’শ ৯০ হেক্টর, সরিষার ল¶্যমাত্রা ১ হাজার ৮’শ ৩০ হেক্টর আবাদ হয়েছে ২ হাজার ১’শ ৩০ হেক্টর, খেসারির লক্ষ্যমাত্রা ১ হাজার ৭’শ হেক্টর আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৬’শ ৯৬ হেক্টর, মসুর লক্ষ্যমাত্রা ৮’শ ১৫ আবাদ হয়েছে ৮’শ ৫৬ হেক্টর, ভ‚ট্টা লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার হেক্টর আবাদ হয়েছে ২ হাজার ১’শ ৫২ হেক্টর, চিনা বাদাম লক্ষ্যমাত্রা ২ হাজার ৩০ হেক্টর আবাদ হয়েছে ১ হাজার ৮’শ ৩০ হেক্টর, মরিচ লক্ষ্যমাত্রা ২’শ ১০ হেক্টর আবাদ হয়েছে ২’শ ১২ হেক্টর, পেঁয়াজ লক্ষ্যমাত্রা ২’শ ৫৫ হেক্টর আবাদ হয়েছে ২’শ ১০ হেক্টর, রসুন লক্ষ্যমাত্রা ১’শ ২০ হেক্টর আবাদ হয়েছে ৯৫ হেক্টর, ধনিয়া লক্ষ্যমাত্রা ৭০ হেক্টর আবাদ চাষ ৬৮ হেক্টর, মিষ্টি আলু লক্ষ্যমাত্রা ১’শ ৪০ হেক্টর আবাদ হয়েছে ১’শ ৪৪ হেক্টর, গম লক্ষ্যমাত্রা ১হাজার ২’শ ৫০ হেক্টর আবাদ হয়েছে ৯’শ ১০ হেক্টর জমি।
ক’বছর আগেও এই চরাঞ্চলের কৃষকরা এক বেলা খেয়ে অন্য বেলা না খেয়ে দিন কাটাতেন। ধান, গম, কলাই, আলু ছিল তাদের প্রধান ফসল। কিন্তু বর্তমানে কৃষকদের সে অবস্থা আর নেই। ভ‚ট্টা, বাদাম ও বিভিন্ন সবজি চাষ করে বদলে গেছে তাদের জীবনধারা। তাদেররই একজন উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ। তিনি ভ‚ট্টাসহ সকল প্রকার ফসল উৎপাদন করে সফল চাষী হিসেবে জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ কৃষকের পুরুষ্কার পেয়েছেন। আব্দুল লতিফ বেশ কয়েক বছর ধরে ভ‚ট্টা চাষ করে আসছেন। তিনি বলেন, প্রতি বিঘায় ৩০-৩৫ মন করে ভ‚ট্টা হয়। প্রতি মণ ভ‚ট্টার মৌসুম বাজার দর ৮’শ থেকে ৯’শ টাকা থাকে। এ হিসেবে প্রতি বিঘায় লাভ হয় ১৮-২০ হাজার টাকা। প্রতি বিঘায় সাথি ফসল আসে ৮-১০ হাজার টাকার। সব মিলিয়ে প্রতি বিঘায় লাভ থাকে ২৫-৩০ হাজার টাকা।
গাবসারা ইউনিয়নের রেহাই গাবসারা গ্রামের বাদাম চাষি আলম মন্ডল জানান, এবার বাদামের ফলন খুব ভাল হয়েছে। তবে কৃষি বিভাগ থেকে আমরা যে প্রণোদনা পাই তা সঠিক সময়ে পাই না। তাই কৃষি বিভাগ থেকে দেওয়া উন্নত জাতের বীজ আমরা বপন করতে পারি না। এ কারণে ফলন কিছুটা কম হয়েছে।
অর্জুনা ইউনিয়নের বাসুদেবকোল গ্রামের কৃষক সাইফুল ইসলাম জানান, শুষ্ক মৌসুমে চরাঞ্চলে নানা ধরনের সবজি চাষ হয়। সবজি চাষ লাভজনক হওয়ায় এবার অনেক সবজি চাষ করেছি। ভাল ফলনও পেয়েছি। আমি কৃষি বিভাগ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে চাষ শুরু করেছি। কৃষি বিভাগ চরাঞ্চলের কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহযোগিতা করলে সবজি চাষেও চরাঞ্চলে বিপ্লব ঘটবে।
ভূঞাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. হুমায়ুন কবির বলেন, চরাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল না হওয়ায় নিয়মিত কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ থেকে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যে সকল জমি বছরে একবার চাষ হয় সে সকল জমিগুলোকে দু’ফসলি করার পরামর্শ দেওয়া হবে। সঠিক সময়ে প্রণোদনার সার ও বীজ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। নিরাপদ ফসল উৎপাদনে সচেতনতায় কীটনাশক মুক্ত শাক সবজি চাষে উদ্ধুদ্ধ করতে হবে। এছাড়াও প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের মাঝে সেবা পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
#চলনবিলের আলো / আপন