১৯২০ সালের ১৭ মার্চের সোনালি সন্ধ্যায় গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়া গ্রামের শেখ পরিবারের প্রাঙ্গণ আলোকিত ও মুখরিত হয়ে উঠেছিল একটি শিশুর জন্ম উপলক্ষে। জন্মলগ্নে মা-বাবা ও আত্মীয়স্বজন খুশিতে শিশুটিকে ‘খোকা’ বলে ডাকতে শুরু করলেন।
নিভৃত পল্লীর ছায়াঘেরা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাইগার নদীর তীরে বেড়ে ওঠা সেই খোকা পরবর্তী সময়ে হয়ে উঠলেন একজন বিশ্বনন্দিত নেতা, একটি স্বাধীন দেশের স্থপতি, একটি জাতির পিতা এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।
জাতির কাছে তিনি পিতা, বিশ্ববাসীর কাছে তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। বিশ্ব ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যিনি একই সঙ্গে একটি স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন জাতির পিতা। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ব্রিটিশ মানবতাবাদী আন্দোলনের অগ্রনায়ক লর্ড ফেন্নার ব্রোকওয়ে একদা মন্তব্য করেছিলেন- ‘নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী ও আয়ারল্যান্ডের জর্জ ডি ভেলেরার চেয়েও মহান ও অনন্য।’
১৯৭২ সালে সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর সাংবাদিক হারুনুর রশীদ খানকে বলেছিলেন, ‘হারুন, আমার সাংবাদিক জীবনে বহু বড় বড় রাষ্ট্রনায়কের দেখা পেয়েছি- ব্রেজনেভ, নিক্সন, হ্যারল্ড উইলসন, এডওয়ার্ড হিথ, কাস্ত্রো, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, ইয়াসির আরাফাত প্রমুখ।
কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো এত বড় নেতা- গোটা বিশ্বে যার নাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়- তিনি এত সহজ-সরল, বিশাল হৃদয়ের মানুষ আমি ভাবতেই পারিনি। সত্যিই তিনি তোমাদের জাতির পিতা। তিনি শতাব্দীর মহানায়ক।’
১৯৭৩ সালে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার সমাজতান্ত্রিক নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে এ মানুষটি হিমালয়ের মতোই উঁচু।’ মিসরের বিখ্যাত সাংবাদিক হাসনাইন হাইকেল বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাংলাদেশের নন, সমগ্র বিশ্বের নেতা।’
বঙ্গবন্ধু তার ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেম দিয়ে বিশ্বসভায় বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন। একজন রাজনৈতিক কর্মী কীভাবে নেতা হয়ে উঠলেন, কীভাবে একটি দেশের স্থপতি হলেন, সেটি আমরা তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বই থেকে বুঝতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর বর্ণাঢ্য জীবন কাহিনী এত অল্প পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয়। তিনি গোটা দেশ ঘুরেছেন। পকেটে পয়সা নেই, কোথায় কখন কী খাবেন তা জানতেন না। হেঁটেছেন, রিকশা বা নৌকায় উঠেছেন, এমনকি ট্রেনের থার্ড ক্লাসেও ভ্রমণ করেছেন। তার কোনো বিলাসবহুল গাড়ি ছিল না।
এত সীমাবদ্ধতার পরও কীভাবে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, কীভাবে জনগণের স্বপ্ন সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতেন- এগুলোই আজ আমাদের রাজনীতির বিবেচ্য হওয়া উচিত।
বঙ্গবন্ধুর সুকৌশল নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের আন্দোলন, সশস্ত্র সংগ্রাম, দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ ছিল অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি বিধ্বস্ত একটি ভূখণ্ড। স্বাধীনতা যুদ্ধে এদেশের অকৃতজ্ঞ স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী আলবদর ও আলশামস বাহিনীর মদদে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার মাধ্যমে বাঙালি জাতির চিন্তাকোষে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়।
এমন একটি শূন্য অবস্থা ও ভয়ানক পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বাঙালি জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ, ঠিক তখনই দেশীয় ও বিদেশি কুচক্রী মহলের গভীর ষড়যন্ত্রে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত নৃশংসভাবে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
বাঙালি জাতির ইতিহাসে ১৫ আগস্টের চেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় আর নেই। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল লক্ষ্য ছিল একটি দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্বাধীনতাকে ভূলুণ্ঠিত করা। তারপর প্রায় দেড় যুগ চলে স্বৈরশাসনের নানা রকম অপকর্ম। শুরু হয় জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিল বিকৃতির খেলা। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উচ্চ পদ দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়।
বর্তমানে শত সংগ্রাম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে এদেশবাসীর মুক্তির সংগ্রামে কাজ করে যাচ্ছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ আজ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে বিধায় উন্নয়নের প্রায় সব সূচকে বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে।
২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সম্পদ সংস্থান, সামাজিক বৈষম্যনিরোধ, লিঙ্গসমতা, জননিরাপত্তা, দারিদ্র্যবিমোচন, কর্মসংস্থান, জনমিতি ইত্যাদি সূচকে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়েছে পাকিস্তান।
১৯৭২ সালে সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে পাঁচ কোটি ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। আর এখন ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে চার কোটি দারিদ্র্যসীমার নিচে। যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বৈষম্য বেড়েছে; কিন্তু নিম্নআয়ের মানুষ শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সুখে আছে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা গরিব-মেহনতি মানুষের জন্য বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। স্বাধীনতার সময় যেখানে মাত্র চার শতাংশ নারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল, এখন তা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সবসময় মনেপ্রাণে উপলব্ধি করতেন, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত ও সমৃদ্ধ একটি সোনার বাংলা গড়তে কৃষিশিল্পের উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, কৃষি একটি জ্ঞাননির্ভর শিল্প। চিরায়িত ও গতানুগতিক কৃষিব্যবস্থার মাধ্যমে দ্রুত বর্ধমান বাঙালি জাতির খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
তাই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষির ব্যাপক আধুনিকীকরণের পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রয়োজনীতা সবসময় অনুভব করতেন তিনি। আর কৃষিশিল্পের আধুনিকীকরণ ও লাগসই উন্নয়নের একমাত্র কারিগর হচ্ছে কৃষিশিক্ষায় শিক্ষিত গ্রাজুয়েটরা। এজন্য বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
বিজ্ঞানমনস্ক ও গবেষণার প্রতি তার এ ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বিদেশেও রফতানি করতে সক্ষম হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী পরিকল্পনায় কৃষিতে অভাবনীয় সাফল্য বিভিন্ন তথ্যচিত্র থেকে আমরা স্পষ্টভাবে অনুধাবন করতে পারি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের দেয়া তথ্যানুযায়ী, দেশের খাদ্যশস্য উৎপাদন আগের প্রায় এক কোটি টন থেকে বেড়ে এখন সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি হয়েছে। পাশাপাশি তৈলবীজ, পেঁয়াজ, রসুন, সবজি, আলুসহ সব নিত্যপণ্যের উৎপাদন বেড়েছে কয়েকগুণ। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে কৃষিতে প্রতি বছর গড়ে ৪.৭ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
কৃষিতে বাংলাদেশ আজ বিশ্ব উদাহরণ। বৈরী আবহাওয়া তথা বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা সত্ত্বেও খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীর কাছে রোল মডেল। এ সবই সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি অবিচল থাকার কারণে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে সব সেক্টরে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পাশাপাশি দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব ও দর্শন যেমন সমগ্র বাঙালি জাতিকে মুক্তি সংগ্রামে সফলতা এনে দিয়েছিল, ঠিক তেমনি তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনার ‘ভিশন ২০২১ ও ২০৪১’ বাস্তবায়নের সংগ্রামেও বাঙালি জাতি আজ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের চেয়েও শোষণ-বঞ্চনামুক্ত ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি উন্নত বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রাম বেশি কঠিন।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও চেতনাকে লালন করে দেশরত্ন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সাফল্যের সঙ্গে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে আজকের বাংলাদেশে পৌঁছাতে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
অক্লান্ত পরিশ্রম আর অসীম ত্যাগের বিনিময়ে আজকের এ বাংলাদেশ। আর যতদিন বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি দেশ থাকবে; বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতা থাকবে; পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা বহমান থাকবে; যতদিন জাতি হিসেবে বাঙালির পরিচয় থাকবে, ততদিন এদেশের প্রত্যেক মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব, চির অম্লান হয়ে বাঙালি চেতনার এক অনির্বাণ শিখা হিসেবে প্রজ্বলিত হয়ে থাকবেন। জাতির পিতার প্রতি জানাই হাজারও সালাম, লাখো শ্রদ্ধাঞ্জলি।
প্রফেসর ড. মো. গিয়াসউদ্দীন মিয়া : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর
(আগামীকাল প্রকাশিত হবে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহর লেখা)