নওগাঁর আত্রাইয়ে বন্যা দূর্গত অসহায় গরীব মানুয়ের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ আমলে নির্মিত করা হয় ‘বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি, বা (এখন গান্ধি আশ্রম)। সময়ের বিবর্তনে অযতœ, অবহেলা, আর স্থানীয় কতিপয় প্রভাবশালীদের কালো থাবায় জরাজীর্ণ অবস্থায় কালের স্বাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি নন্দন এ গান্ধি আশ্রম। জনশ্রুতি আছে এই জনপদের বন্যা দূর্গত মানুদের সাহায্য সহযোগীতা করতে বিভিন্ন ধরণের খাদ্য সামগ্রী ও ওষুধ পত্র নিয়ে রিলিফ দিতে এসেছিলেন স্বয়ং মহাতœা গান্ধি নওগাঁর পুন্যভূমি আত্রাইয়ে।
গান্ধির ব্যবহৃত বেশ কিছু আসবাবপত্র ও কুটির শিল্পে ব্যবহৃত ঐতিহাসিক সামগ্রীগুলো সংস্কারের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারিভাবে রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ না থাকায় বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি গান্ধি আশ্রমের কিছু জমি-জমা স্থানীয় প্রভাবশালীরা ইতেমধ্যেই জবর দখল করে নিয়েছে। যা নিয়ে গান্ধি আশ্রমের পক্ষ থেকে আদালতের দারস্থও হতে হয়েছে।
বিভিন্ন তথ্য সূত্রে প্রাতভাবে জানা যায়, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর উদ্যোগে বিজ্ঞানী আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কর্তৃক বরেণ্য রাজনৈতিক মহাতœা মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ রেলওয়ে ষ্টেশনের পূর্ব পার্শ্বে ভর-তেঁতুলিয়া মৌজায় ৯ একর জমির উপরে ১৯২২ সালে বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি (গান্ধি আশ্রম/খাদি প্রতিষ্ঠান) নামে এর নামকরণ করা হয়।
তৎকালিন ভারত উপ-মহাদেশের বেশ কিছু এলাকায় ব্যাপক বন্যা হলে এই জনপদে তা ছড়িয়ে পরে। দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ বালাই দেখা দিলে সেই সময়ের ব্রিটিশ বিরোধেী আন্দোলনের নেতা ড.প্রফুল¬্য চন্দ্র রায় (পিসি রায়) মহাতœা গান্ধি ও নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসুর সহযোগীতায় বঙ্গীয় রিলিফ কমিটির মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ অসহায় মানুষদেরকে সহযোগীতায় ত্রান বিতরণ করা হয়।
সেই সময় তাদের লক্ষ্য ছিলো এই এলাকায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের মাঝে ত্রান বিতরণ, অসহায় দরিদ্র সাধারণ মানুষের আতœকর্ম সংস্থানের মাধ্যমে স্ব-নির্ভর করে গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে গান্ধি আশ্রমে স্থানীয় ও দেশি প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে খাঁটি ভেজাল মুক্ত পন্য উৎপাদন, বিপনন এবং বিনা মূল্যে এই এলাকার অসহায় গরীব মানুষের সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করায় এই প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিলো।
তার ধারাবাহিকতায় অন্য সংক্ষিপ্ত কর্মসূচির মধ্যে ছিলো চরকাতে সূতা কাটা, তাঁত প্রকল্প, খাঁটি সরিষার তেল, ঢেঁকি ছাঁটা চাল, দুধ, দুগ্ধজাত দ্রব্য, মৌমাছির চাক থেকে মধূ সংগ্রহ, মার্তৃমঙ্গল শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা, পশু পালন ও মৎস্য চাষ পুরো দমে চালু ছিলো। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে পাক-হানাদার বাহিনীর বর্বর আক্রমণে ’বঙ্গীয় রিলিফ কমিটির গান্ধি আশ্রমের’ সকল অবকাঠামো প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। দেশ স্বাধীনের পর স্থানীয় কিছু ব্যক্তিবর্গের সাহায্য সহযোগীতায় ১৯৮৫ সালে গান্ধি আশ্রমের পুনঃগঠনের কাজ শুরু করা হয়। ১৯৮৮ সালের দিকে নওগাঁ সমাজ সেবা অধিদপ্তর থেকে রেজিষ্ট্রেশন করা হয়। যার নাম্বার নওগাঁ-১৭২। ১৯৯১ সালে ২১ অক্টোবর এডাব বাংলাদেশ বগুড়া চ্যাপ্টারে প্রাথমিক সদস্যপদ লাভ করেন।
মূলত প্রতিষ্ঠানটি সেই সময় দেখা শোনা করতেন ডা.পিসি রায় নিজেই। এলাকায় জনশ্রুতি আছে ১৯২৫ সালে মহাতœা গান্ধি আত্রাইয়ের এই প্রতিষ্ঠানে আসেন। এলাকাবাসির আতœকর্মসংস্থানের জন্য প্রথমে খদ্দর কাপড় তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। ফলে পরবর্তীতে খাদি প্রতিষ্ঠান হিসেবে এটি এলাকায় সমধিক পরিচিতি লাভ করে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরও তার কার্যক্রম অব্যহত ছিল্।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক-বাহিনীর হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের পর এই জনহিতকর প্রতিষ্ঠানটি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। নওগাঁ-৬ আসনের প্রায়ত এমপি ইসরাফিল আলম, সাবেক এমপি ওহিদুর রহমান এবং বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ডাঃ নিরাঞ্জন দাস এই প্রতিষ্ঠানটি সুরক্ষায় এগিয়ে আসেন। তারা সেই সময়ে ভারতীয় হাই কমিশনার পঙ্কজ শরণ এর কাছে গান্ধি আশ্রমের ইতিহাস আদর্শ ও ঐতিহ্য তুলে ধরেন। পরে সেখান থেকে ১২ লক্ষ টাকা আর্থিক অনুদান পাওয়ায় এর সাথে যোগ হয় স্থানীয় সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলমের ব্যক্তিগত অর্থের সমন্বয়ে গান্ধি আশ্রমভূক্ত বঙ্গীয় রিলিফ কমিটির মিলনায়তন, চেম্বারসহ বিভিন্ন পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হয়। এরপর ভারতীয় ফাস্ট সেক্রেটারি দিব্যারঞ্জন রায় কর্তৃক প্রায় সাড়ে ৬৬ লক্ষ টাকা পাওয়া গেলে দ্বিতল ভবন নির্মাণ ও দাতব্য চিকিৎসালয়ের জন্য যন্ত্রপাতি, পাঠাগার, প্রাচীর নির্মাণ, পুকুর খনন, ও ডায়েবেটিক রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় সহকারী হাই কমিশনার রাজশাহী মি. অভিজিৎ চট্র্যোপাধ্যায় মেমোর্যান্ডাম এই স্বাক্ষর করেন। অদ্যাবধি এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতি সরকারি কোন নজরদারি না থাকার সুযোগে এলাকার সুযোগ সন্ধানী প্রভাবশালীরা ইতোমধ্যেই জবর দখল করে নিয়েছে প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু জায়গা জমি। স্থানীয়রা বলছেন সরকারি ভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই জমিগুলো উদ্ধার করে মহাতœা গান্ধির স্মৃতি বিজড়িত ঐতিহাসিক বঙ্গীয় রিলিফ কমিটির আশ্রমটি পুনরায় আগের মতো চালু করা হোক।
আত্রাই উপজেলার সিনিয়র সাংবাদিক ফরিদুল আলম পিন্টু বলেন, এক সময় এই প্রতিষ্ঠানটি ছিলো জমকালো। ১৯৭১ সালে পাক-হানাদাররা আগুন দিয়ে মহাতœাগান্ধির ঘরসহ পুরো প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়। যুদ্ধপরবর্তীতে জীবন ডাক্তার নামে এক ব্যক্তি জাল দলিলের মাধ্যমে গান্ধি আশ্রম দখলের চেষ্টা করলে তৎকালিন প্রতিষ্ঠানের জেনারেল সেক্রেটারি বীর মুক্তিযোদ্ধা খায়রুল ইসলামের নের্তৃত্বে জীবন ডাক্তারকে বিতারিত করে তা পুনরুদ্ধার করেন। বতর্মান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রয়াত এমপি ইসরাফিল আলমের ছোঁয়ায় কিছুটা উন্নতি হলেও বর্তমানে সীমানা প্রাচীর না থাকায় এখানে মাদক সেবিদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে। মাতœাগান্ধির স্মৃতিবিজরিত এই প্রতিষ্ঠানটি অতিতের গৌরব ফিরে পেতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দৃষ্টি কামনা করছি।
প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক ডা. নিরাঞ্জন দাস বলেন, মহাতœা গান্ধি ও পিসি রায়ের ব্যবহৃত বেশ কিছু আসবাবপত্র ও কুটির শিল্পের ব্যবহৃত ঐতিহাসিক সামগ্রীগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় সেগুলো অযতেœ আর অবহেলায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অর্থ অভাবে স্মৃতি বিজড়িত সামগ্রীগুলো সংরক্ষন করা যাচ্ছে না। এছাড়া আশির দশকের দিকে পল¬ীবিদ্যুৎ এই প্রতিষ্টানের তিন একর জমি ভুয়া দলিলের মাধ্যমে অধিগ্রহণ করে নেয়। ঘটনাটি জানতে পেরে আদালতে মামলা দায়ের করা হয়ে্েছ। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাবে এখানে মাদক ক্রয় বিক্রয় আর নেশাখোরদের আড্ডাখানায় পরিণত হয়েছে।
আত্রাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইকতেখারুল ইসলাম বলেন, নওগাঁর আত্রাই উপজেলা একটি সমৃদ্ধশালী এলাকা হিসেবে পরিচিতি, এখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পদচারণা ছিলো। আমাদের প্রতিবেশি বন্ধু প্রতিম দেশ ভারতের জাতির পিতা মহাতœাগান্ধি এখানে এসেছিলো বলে জনশ্রুতি আছে। এখানে বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি নামে প্রতিষ্ঠান থেকে তৎকালিন সময়ে এই জনপদে বন্যা দূর্গত অসহায় মানুষের আর্তমানবতার সেবায় কাজ হতো। ইতিমধ্যে সেখানে গান্ধি চত্বরসহ বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েরেছ। উপজেলা প্রশাসন এবং বাংলাদেশ সরকার ও আন্তরিক আছে। এখানে আরো উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড হাতে নেয়া হবে।