আজ শুক্রবার ৪৭ তম বিশ্ব পরিবেশ দিবস জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হল ‘প্রকৃতির জন্য সময়’ ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবসের বিশেষ কলাম লিখেছেন, সবুজ আন্দোলনের কার্যনির্বাহী পরিষদের পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পাদক, ও দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য সম্পাদক ডা.এম এ মাজেদ তার কলামে লিখেন…. আমাদের চারপাশের জলবায়ু, গাছপালা, মাটি, অন্যান্য প্রাণী, মানুষ, জৈব ও অজৈব সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ৷ পৃথিবীর পরিবেশ জীব বিকাশের পক্ষে অনুকূল বলেই এই পৃথিবীতে মানুষের বাস৷ অথচ সৌরজগতের আর কোথাও বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোথাও এখন মানুষ জীবের সন্ধান পাচ্ছে না৷ হয়তো বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোথাও না কোথাও জীব আছে৷ হয়তো, দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের সংসারে৷ যেমন এ সূর্যের সংসারে পৃথিবী— এমনি কোনো পৃথিবী আছে সেখানে হয়তো মানুষ আছে, কিন্তু এখনো আমাদের বিজ্ঞানীদের জানার বাহিরে৷ তাই এখন আমরা বলতে পারি, এ সুবিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে একমাত্র পৃথিবীর পরিবেশ মনুষ্য বসবাসপোযোগী৷ এর বাইরে মানুষের বাঁচবার বেড়ে ওঠবার কোন স্থান নেই৷
কিন্তু আমাদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্যে এই পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমশইঃ দূষিত হয়ে যাচ্ছে— মনুষ্যবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে৷
জল দূষণ,বায়ূদূষণ,মাটি দূষণ, সবকিছুকেই আমরা দূষিত করে চলেছি৷ কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যপদার্থ, মানুষের দৈহিক বর্জ্যপদার্থ—মল-মুত্র, পচা-গলা পশুদেহ বা মনুষ্য দেহ— এসবই নিয়মিত জলকে দূষিত করছে৷ পতিত পাবনী গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্যে এখন ‘মাষ্টার প্ল্যান’ নিতে হচ্ছে৷ কিন্তু কাজ খুব একটা এগুচ্ছে না৷
গাছপালা বায়ুতে অক্সিজেনের জোগান দেয়, বায়ুর ধূলা, ধোঁয়া প্রভৃতি শুষে নেয়, বৃষ্টি ঘটায়৷ কিন্তু মানুষ অতিলোভের বশবর্তী হয়ে বনজঙ্গল দ্রুত ধবংস করছে ও নানান পশুপাখীও ধবংস করছে৷ এই পশুপাখীরাও প্রাকৃতিক ভাবে পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে৷ আমাদের রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে পশুপাখী মেরে খেয়ে ফেলছি৷ যার ফলে আসলে আমরা নিজেদের সভ্যতার মূলেই কুঠারাঘাত করছি৷
মূলতঃ আমাদের দোষেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ বায়ুদূষণ বাড়ছে৷ তার সঙ্গে আমাদের অতিলোভের ফলে খাদ্যে দূষণ , পানীয়ে দূষণ৷ কিছুই প্রায় দূষণমুক্ত নয়৷ ফলে নানান কঠিন কঠিন ব্যাধি জন্ম নিচ্ছে৷
এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে ষ্টকহোমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিত হয়ে এই সমস্যার থেকে বাঁচবার জন্যে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন৷ পরিবেশ দূষণ বিশ্বের সমস্ত মানুষের কাছে বিপদ ডেকে আনছে৷ তাই একে মোকাবিলা করার জন্যে বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে তথা বিশ্বের সমস্ত জনসাধারণকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে৷ সেই বিশ্ব সম্মেলনে পরিবেশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলবার জন্যে প্রতিবছর ৫ই জুনকে ‘পরিবেশ দিবস’ হিসাবে পালন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ ৫ই জুন ‘পরিবেশ দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়৷ এই দিনে বিভিন্ন মিটিং, মিছিল, আলাপ-আলোচনা ও কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করা হয়৷
পরিবেশকে বিশুদ্ধ করার জন্যে আমাদেরকে সংকল্প নিতে হবে, আর বন, সেই থেকে প্রতি বছর ধবংস নয়, বরং বনসর্জন চাই৷ সেক্ষেত্রে নিতান্ত যদি প্রয়োজনে কোনো একটি গাছ কাটতেই হয়, তাহলে তার পরিবর্তে যেন দশটি গাছ লাগাই৷ এছাড়াও প্রতি বছর ব্যাপকভাবে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিতে হবে৷ জল পরিবেশের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ৷ বলা হয় জলের অপর নাম জীবন৷ জল পানীয়ের জন্যেও যেমন প্রয়োজন, কৃষিকার্যের জন্যেও জল প্রয়োজন৷ আমাদের পানীয় জলের অভাব মেটাতে ও কৃষিকার্যের জন্যে আমরা সহজে ভূগর্ভ থেকে জল তুলছি৷ এটা ভবিষ্যতের জন্যে অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ তাই মাটির নীচের জলভান্ডারে হাত না দিয়ে প্রকৃতি বৃষ্টিরূপে যে বিপুল জনসম্পদ দান করেন, সে জলকে সংরক্ষণ করতে হবে৷
১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে বা মানুষকে বৃহত্তর আদর্শে উদ্ধু দ্ধ করে নদী, নালা, খাল-বিলকে সংস্কার করে তাদের জলধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ তাতে বন্যার প্রকোপও হ্রাস পাবে৷ গ্রামে গ্রামে ব্যাপকভাবে জলাশয় বানাতে হবে৷ ‘জল ধরো, জল ভরো’ — এক শ্লোগানটিকে কেবল রাজনৈতিক শ্লোগান না রেখে যথার্থ ভাবে কাজের কাজ করতে হবে৷ বৃষ্টির জলকেই আটকে রেখে সারা বছরের কৃষিকাজে লাগাতে হবে ও তাকে শোধন করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে৷
মোটকথা মানব সভ্যতার রক্ষার স্বার্থে এই পৃথিবীর মনুষ্যবাসোপযোগী পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে৷
সবচেয়ে বড় কথা, যে মানুষ এই পরিবেশ রক্ষা করবে— বিশুদ্ধ করবার মহান দায়িত্ব বহন করবে, সে মানুষের মনকে আগে বিশুদ্ধ করবার চিন্তা করতে হবে৷ কেননা ভালমন্দর সবকিছুর সৃষ্টি আগে মানুষের মনে৷
★ পরিবেশ দূষণের কারণঃ-
দূষিত পরিবেশের প্রভাবে জীব জগতের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এতে মানুষের জীবনধারা ব্যাহত হয়।
পরিবেশের অপরিহার্য বিভিন্ন উপাদান যেমন – বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের ফলে পরিবেশ সংকট দেখা দেয়। পরিবেশ সংকটে মানব জীবন বিপুল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং জীব জগতের স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
পরিবেশের উপাদানগুলো দূষণের ফলে নানা রোগ ব্যাধি ছড়ায়। পানি দূষণের ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, চুলকানি ইত্যাদি রোগ হয়। শব্দ দূষণের ফলে হৃদরোগ, মাথাব্যথা, মানসিক সমস্যা ও কানের অসুখ হয়। বায়ু দূষণের ফলে ফুসফুসের অসুখসহ নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। এছাড়া মাটি দূষণের ফলে রোগ উৎপাদক বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব ছড়ায়। এছাড়া জমির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে খাদ্য ও অর্থ সংকট দেখা দেয়।
পরিবেশ দূষণের অনেক কারণের মধ্যে নগরায়ন, শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ, গাছপালা কর্তন, সার ওষুধ কীটনাশকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ও পশুপাখির মৃতদেহ ফেলা, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, গাড়ি কারখানা ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া, কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি, বনভূমি কমে যাওয়া, নলকুপ স্থাপন, ভূমির অপর্যাপ্ততা, ভূমি ক্ষয়, অপরিকল্পিত চুলা ও জ্বালানি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
পরিবেশ দূষণ জনস্বাস্থ্যের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা মানবজাতিকে পরিবেশ সংকট বিপন্ন করতে পারে।
পরিবেশ দূষণ রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ দূষণ প্রতিকার করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে গণমাধ্যমে বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে, গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে, বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে, পশুপাখির মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান ও সম্পদের সংরক্ষণ, সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিতে হবে, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ কয়লা তেল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জনবসতিপূর্ণ স্থানে ইটভাটা বন্ধ করতে হবে ও ইটভাটা অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে, পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।
★ পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঃ-
স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। বাক্যটির যথার্থ প্রচলন রয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ পরিবেশগত। বর্তমান সময়ে পরিবেশদূষণের ফলে মানুষ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য দরকার দক্ষ মানব সম্পদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বারডেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের ডিপার্টমেন্ট অব অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ চালু করেছে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি বা পরিবেশ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে স্নাতক। এই বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে পরিবেশদূষণ কী কারণে হয়, বিষাক্ত উপাদান কীভাবে আমাদের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, কীভাবে এই দূষণের প্রভাবগুলো শনাক্ত, প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়—এসব ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান দেওয়া হয়। দুর্যোগ মোকাবিলা পদ্ধতিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগর স্বাস্থ্য ও পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ আরও অন্যান্য বিষয় এর পাঠ্যতালিকাভুক্ত। তবে স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখার জন্য যা যা থাকা দরকার তা আছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন অনেক। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখার জন্য অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই যে বিষয়টা প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। তবেই বাক্যটার যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে। সুন্দর পরিবেশ ভালো থাকার মূলমন্ত্র, যা প্রতিটি নাগরিকের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বহন করে। কিন্তু আমরা কি সেই পরিবেশ পাচ্ছি? আমাদের চারপাশ বিবেচনা করলে বিষয়টা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। শহর এবং গ্রাম দুই স্থানেই এই প্রশ্ন সমভাবে প্রযোজ্য। জীবনের তাগিদে মানুষ আজ শহরমুখী। সংজ্ঞা যেন এমন স্বল্পপরিসরে অধিক মানুষের বসবাস যেখানে তার নাম শহর। সেখানে নাগরিক সুবিধা চাই থাকুক আর নাই থাকুক। সেটা দেখার বিষয় নয়। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই হলো। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পাওয়াটা তাদের কাছে এতটা জরুরি বিষয় নয়। আর যেখানে মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছে, সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পাওয়াটা সত্যিই হাস্যকর। তবু কি এর প্রয়োজন নেই? হ্যাঁ অবশ্যই আছে, দেহকে সুস্থ রাখতে হলে বা রাখতে চাইলে এই পরিবেশ ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। তবে পরিসংখ্যাটা আমাদের নেতিবাচক সংবাদই বহন করে। কেননা চাকরি সুবাদের হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, শহরের দিকে ধাবিত হওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। পরিবেশ দুষণের কারণে কিছু ক্ষতি প্রত্যক্ষভাবে হচ্ছে। যেমন কীটনাশক মেশানো লিচু খেয়ে শিশু মারা গেল বা বিষাক্ত মাছ খেয়ে কেউ অসুস্থ হলেন। আবার কিছু ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। যেমন রাসায়নিক বা কীটনাশক মেশানো বা বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারো কিডনি নষ্ট হয়ে গেলো। বা দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে থেকে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হলেন।
* শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি
বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণের শিকার দরিদ্র নারী, শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ তাদের বেশিরভাগই দূষিত এলাকায় বসবাস করেন, যেখানে সীসা দূষণেরও ঝুঁকি রয়েছে এর ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে।
* গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন: দূষণের কারণে বাংলাদেশের বছরে ৬৫০ কোটি ডলার ক্ষতি হয় যা মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ
দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে। এসব এলাকার দূষিত বায়ু এবং পানির কারণে তার নিজের এবং গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
* বায়ু দূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দুষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বায়ু দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।
* ক্যান্সার ও হৃদরোগ
দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।
* পানি দূষণের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী
যুক্তরাজ্যের ওয়াটার পলুউশন গাইড, যারা পানির মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমাতে কাজ করছে, তারা বলছে, পানি দূষণে সাময়িক প্রভাবের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনেক বেশি পড়ে। বিশেষ করে শিল্প কলকারখানার বজ্য মানব দেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। এসব পানি ব্যবহার চর্মরোগ, টাইফয়েড, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের মতো রোগ হতে পারে।
* খাদ্যচক্রের মাধ্যমে ক্ষতি
বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুষিত পানি বা নদীর ভেতর যেমন মাছ বা প্রাণী থাকে, যেসব ভেজষ উৎপন্ন হয়, দূষণ সেসব প্রাণীর ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর পদার্থ আবার মানব দেহের শরীরে চলে আসে। ফলে সরাসরি দূষিত পানির কাছাকাছি না থাকলেও, সেসব দুষিত পদার্থ এসব মাছের মাধ্যমে মানব দেহে আসে, যার ফলে ক্রুটি পূর্ণ জন্ম বা ক্যান্সার হতে পারে। এমনকি খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকছে সীসা, প্লাস্টিকসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ।
* শব্দ দূষ ণের কারণে হাইপার টেনশন, খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনীসহ প্রতিটি পণ্য সংরক্ষণে ব্যবহার হয় প্লাস্টিক, যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আবার মানব শরীরে প্রবেশ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ নয়েজ কন্ট্রোল বলছে, পথের শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ক্রুটির তৈরি হতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে ব্লাড প্রেশার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যার তৈরি হতে পারে।
* খাদ্য দূষ ণে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ
খাদ্য দূষণের কারণে অন্ত্রের নানা রোগ, লিভার, কিডনি বা পাকস্থলী কার্যকারিতা হারাচ্ছে। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা সমস্যার তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো এসব কারণে ক্যান্সারেরও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে এ ধরণের দুষিত খাবার খেলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।
★ রক্ষা পাওয়ার কি উপায়?
পরিবেশ দূষণ এড়ানোর জন্য শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। নিজেরা আগে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।”
শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে
শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে
”আইনের প্রয়োগ তো করতেই হবে, সেই সঙ্গে বায়ু দূষণ যাতে না হয়, পানি বা শব্দ দূষণ না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের নিজেদের সতর্ক হতে থাকতে হবে।
লেখক, ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
সম্পাদক, দৈনিক স্বাস্থ্য তথ্য
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কার্য নির্বাহী পরিষদ
ইমেল, drmazed96@gmail. com