সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলায় ফসলের মাঠ এখন সরিষার ফুলে ফুলে হলুদ রঙে সেজেছে। চারি দিক হলুদের সমারোহ। চোখ মেললেই মন জুড়িয়ে যায়। পুরো মাঠ যেন ঢেকে আছে হলুদ চাদরে। ফুলে ফুলে মৌমাছি আর প্রজাপতির নাচনে গ্রামীণ জনপদ হয়ে উঠেছে আরো মনোমুগ্ধকর। প্রকৃতি যেমন অপরুপ ভাবে সেজেছে, ঠিক সেই সঙ্গে মেতে উঠেছে পেশাদার মধু সংগ্রহে মৌয়ালরা।
সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহে এসব জমির পাশে পোষা মৌমাছির শত শত বাক্স নিয়ে হাজির হয়েছে মৌয়ালরা। বাক্স থেকে হাজার হাজার মৌমাছি বের হয়ে মধু সংগ্রহে ঘুরে বেড়াচ্ছে সরিষার ফুলে ফুলে। এই অপরূপ দৃশ্যে যেকোনো প্রকৃতি প্রেমীকে আকৃষ্ট করবে। বেশির ভাগ মৌ চাষী এসেছেন সাতক্ষীরা, ফরিদপুর সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। এই সরিষা থেকেই মিলছে খাঁটি মধু, খাটি তৈল, গরুর স্বাস্থ্যকর খাবার, খৈল, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে সরিষার গাছ। সরিষা চাষে খরচও কম, তাইতো কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় উপজেলা জুড়ে প্রতি বছরের ন্যায় এবার আরও ব্যাপকভাবে সরিষা চাষ হয়েছে।
মৌমাছির গুঞ্জনে মূখরিত ও হলুদ চাদরে ঢেকেছে কৃষি মাঠ। এতে সরিষা ফুলে সহজেই পরাগায়ন ঘটে। সরিষাক্ষেতের পাশে মৌ চাষের বাক্সস্থাপন করলে, সরিষার ফলন অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ে। তৎসঙ্গে মৌয়ালরা মধু আহরণ করেও লাভবান হন।
সরেজমিন দেখা গেছে, উপজেলার খাষকাউলিয়া বাহলগড়া, কুরকি চারব্রীজ, বৈন্যা কোদালিয়া, রেহাই পুকুরিয়া, ঘোরজান সহ বিভিন্ন এলাকায় মৌচাষীরা সরিষা ক্ষেতের পাশে বাক্সে মৌ চাষ করছে। এসব জমিতে সরিষার ফুল ফুটেছে আরো সপ্তাহ দু-তিয়েক আগেই। ফুলের মধু আহরণে নেমেছেন, পেশাদার মৌয়ালারা। তাদের বাক্স থেকে দলে দলে উড়ে যাচ্ছে পোষা মৌমাছি, আর সংগ্রহ করছে মধু। মুখভর্তি মধু সংগ্রহ করে মৌমাছিরা ফিরছে বাক্সে রাখা মৌচাকে। সেখানে সংগৃহীত মধু জমা করে আবার ফিরে যাচ্ছে সরিষা ক্ষেতে। এভাবে দিনব্যাপী মৌমাছিরা যেমন মধু সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করছে। ফুলে ফুলে ঘুরে মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে পুরো জমির পরাগায়নেও সহায়তা করে। এ মৌসুমে মৌয়ালরা পোষা মৌমাছি দিয়ে প্রচুর মধু উৎপাদন করে যেমন লাভবান হচ্ছেন ঠিক তেমনি মৌমাছির ব্যাপক পরাগায়নে সরিষার বাম্পার ফলন হওয়ার সম্ভাবনায় চাষিরাও বাড়তি আয়ের আশা করছেন।
মধু সংগ্রহ ব্যবসায়ী নুরনবী বলেন, চৌহালীতে কোন মৌয়াল সৃষ্টি হয়নি, তবে বিভিন্ন গাছ ও ভবনে মৌমাছি চাইক বসায়, চাইক কেটে সেখান থেকে মধু সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে বছরে যে টাকা আয় হয় তাদিয়ে কোন রকম সংসার চলে। তবে সরকারি ভাবে কোন প্রশিক্ষণ নেই। কৃষি অফিস ও প্রশাসন আমাদের প্রশিক্ষণ এবং অর্থ যোগান দিলে আমরাও মৌচাষ করে সংসারের চাকা ঘোচাতে পারবো।
মোয়াল রফিক বলেন, বৃষ্টি হওয়ায় সরিষা ক্ষেত ও মধু সংগ্রহ কিছুটা সমস্যা হয়েছে।
বর্তমানে মৌ চাষে প্রতি বাক্স থেকে সপ্তাহে ৩ থেকে ৪ কেজি মধু সংগ্রহ করা যায়। তবে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে মধু সংগ্রহ বেশি হয়। ২৫০টি বাক্সে ৩২০ থেকে ৩৫০ কেজি মধু সংগ্রহ করা হয়, যার বাজারমূল্য ৬০থেকে ৬৫ হাজার টাকা। মৌ চাষে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। মৌ চাষের কারণে একদিকে যেমন সরিষা উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে অল্প খরচে মৌ চাষ দূর করতে পারে বেকারত্ব।
মৌয়াল ব্যবসায়ী শরিফ জানান, আমরা প্রতি বছর সরিষা ক্ষেত থেকে অনেক খাঁটি মধু সংগ্রহ করে থাকি। এসব মধুর অনেক চাহিদা, বেশ ভাল দামে মধু বিক্রি করা যায়। আগে সরিষা চাষিরা মনে করতো যে এভাবে মধু সংগ্রহ করলে সরিষার ক্ষতি হয়। কিন্তু এখন তারা বুঝতে পেরেছে মধু সংগ্রহে সরিষার ফলন আরো ভাল হয়।
সহকারি কৃষি অফিসার মোবারক হোসেন বলেন, অন্যান্য উপজেলার মতো চৌহালীতে মধু চাষ হয়না কারণ এখানে চরাঞ্চল ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনপদ। তবে গত বছরের চেয়ে এবছর একশ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ বেশী করা হয়েছে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো, মাজেদুর রহমান জানান, উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে এ বছর প্রায় ২ হাজার ৫’শ ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় উভয় জাতের সরিষা কৃষকরা চাষ করেছে। দুই জাতের সরিষা নভেম্বরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আবাদ করতে হয়। ফসল ঘরে উঠতে সময় লাগে জাত ভেদে ৭৫ থেকে ৯০ দিন। এই পর্যন্ত খুলনা ও সাতক্ষীরার বিভিন্ন উপজেলা হতে আগত ৯৫০ টি বক্স স্থাপন করা হয়েছে। এবছর কৃষিতে বেশি হওয়া উৎস জমিতে কলাইয় আবাদে মিশ্র সরিষা চাষ।
চৌহালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহবুব হাসান জানান, স্থানীয় ভাবে কোনো মৌ চাষ করা হয় না। যারা মৌ চাষ করছেন তারা সকলেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মৌয়াল। তাই এখানে মৌ চাষে এলাকার চাষীদের উদ্বুদ্ধকরণে কার্যক্রম শুরু করা হবে ইনশাআল্লাহ।