সোমবার , ২২শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ || ৭ই আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ - শরৎকাল || ৩০শে রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার মাছ ধরার ফাঁদ ‘চাঁই’

প্রকাশিত হয়েছে- শনিবার, ২২ জুলাই, ২০২৩

এখন চলছে বর্ষা মৌসুম। আর এই সময়ে বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ভরে গেছে খাল, বিল, মাঠ-ঘাটসহ সব নিচু অঞ্চল। পানিতে দেখা যায় দেশি বিভিন্ন জাতের ছোট ছোট মাছ। আর সেই মাছ ধরতে জমির আইলে কিংবা অন্য কোনো স্থানে অল্প পানিতে সহজেই মাছ ধরার জনপ্রিয় একটি প্রাচীন উপকরণ হচ্ছে চাঁই।

গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাছ ধরার ফাঁদ ‘চাঁই’। চলনবিলে বিভিন্ন অঞ্চলে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর ও হাওড়-বাঁওড়ে বিশেষ কায়দায় মাছ ধরার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় বাঁশ দিয়ে নিপুণ হাতে তৈরি করা চাঁই। এখন ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরার এ বিশেষ ফাঁদ ‘চাঁই’ বিলুপ্ত হওয়ার পথে।

এরইমধ্যেই শিকারের নানা উপকরণ সহ চাঁই তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বিলাঞ্চলের মৌসুমি কারিগররা। মূলত, বিলাঞ্চলে চাহিদার প্রে¶িতে চাঁই তৈরির সঙ্গে জড়িত কারিগররা ঘরে বসেই মাছ শিকারের যাবতীয় দেশীয় উপকরণ তৈরি করে থাকেন।
দেশীয় মাছের জন্য বিখ্যাত চলনবিল। চাটমোহর সহ চলনবিলের মাঠ, নদী ও বিলে নতুন পানি এসে ভরে উঠছে। ফলে খাল, বিল, ডোবা-জলাশয় পানিতে টইটুম্বর। সেই সঙ্গে বিশাল জলরাশিতে প্রায় ৩-৪ মাস পেশাদার ও সৌখিন মৎস্য শিকারীদের মাছ শিকারে জমে উঠবে চলনবিলের বিভিন্ন এলাকা। তাই চাটমোহর সহ চলনবিল অঞ্চলের বিভিন্ন হাটে ছোট মাছ ধরার সরঞ্জাম চাঁই উঠেছে।

বিশেষ করে চলনবিল অধ্যুষিত পাবনা জেলার চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া ও ফরিদপুর, নাটোর জেলার গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম ও সিংড়া, সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ ও উল্লাপাড়া সহ চলনবিলের বিভিন্ন উপজেলার অনেক গ্রামের চাঁই তৈরির কারিগররা বহু বছর ধরে মৌসুমি এ পেশার মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। তবে বর্তমানে এ পেশা টিকে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন কারিগররা।
চাটমোহর উপজেলার হরিপুর ধরইল মৎস্যজীবী পাড়ায় সরজমিনে গেলে কথা হয় চাঁই তৈরির কারিগর মিরাজ উদ্দিন ও নিজাম পরামানিকের সঙ্গে। তারা জানান, মাছ ধরার সামগ্রী চাঁই তৈরিতে প্রয়োজন বাঁশ, তালের ডাকুর, দা, কাস্তি, আঁশ ছাড়ানোর জন্য বাঁশের চুঙ্গি।

প্রথমত, বাঁশ ও তালের ডাকুর ৭ থেকে ১০ দিন পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে পানি থেকে তুলে ওই তাল গাছের ডাকুর গুলো থিতিয়ে আঁশ ছড়ানো হয়। আঁশ একটু রোদে শুকাতে হয়। তার পর পানি থেকে বাঁশ তুলে পরিমান মতো বাঁশ কেটে খিল (কাঠি) তোলার পরে রোদে শুকানো হয়। খিল চাঁই বাঁধার কাজে ব্যবহৃত হয়।

মুলতঃ তল্লা বাঁশ দিয়ে চাঁই তৈরি করে বেশি সুবিধা হয়। তাই তল্লা বাঁশও পানিতে ভিজিয়ে রাখলে বেশি ভালো হয়। ওই ভেজা বাঁশ রোদে শুকিয়ে দা দিয়ে চিরে ভাগ ভাগ করে সুবিধামতো চাঁইয়ের দুই পাশ শক্ত করে আটকানো হয়। তার পর তৈরি করা হয় চাঁই।
একই গ্রামের কারিগর আব্দুল মজিদ বলেন, চাঁই তৈরির কাচামাল বাঁশ ও তাল গাছের ডাকুর বিভিন্ন হাট বাজার ও গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে বাড়ি থেকে কিনে আনতে হয়। এগুলো সংগ্র করা অনেকটাই কষ্টকর। তবে সা¤প্রতিক সময়ে বাঁশের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাল গাছের ডাকুরও আগের চেয়ে একটু বেশি দামে কিনতে হয়। তিনি আরো বলেন, এ পেশায় আর আগের মতো লাভ নেই। পেশা ধরে রাখতে সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইতি মধ্যেই এ পেশা পাল্টিয়ে অন্য পেশায় গেছেন অনেক কারিগররা। চাটমোহর উপজেলায় ৭শ থেকে ৮শ পরিবারের মধ্যে বর্তমানে প্রায় ৩শ পরিবার এ পেশা ধরে আছেন।

গুরুদাসপুরের ধারাবারিষা গ্রামের মন্ডল পাড়ার চাঁই তৈরির কারিগর শহিদুল ইসলাম বলেন, চায়না দুয়ারী ও কারেন্ট জালের জন্য দিন দিন চাঁইয়ের চাহিদা কমতে শুরু করায় চাঁই তৈরির কারিগরদের জীবনে নেমে এসেছে দুর্দিন-দুর্দশা। বাপ দাদার এ পেশা আর ধরে রাখতে পারছি না। তিনি আরো বলেন, একটা চাঁই তৈরি করতে বাঁশ ও তালের ডাকুর কিনে তা বিভিন্ন প্রক্রিয়া শেষে প্রায় ৩০০ টাকা খরচা হয়। বাজারে ওই চাঁই ৩০০-৩৫০ টাকা বিক্রি করতে হয়। বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন পণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু নিষিদ্ধ চায়না দুয়ারী ও কারেন্ট জালের কারনে এই চাঁইয়ের দাম বৃদ্ধি হচ্ছে না। কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। ওই এলাকার প্রায় ৫শ পরিবারের মধ্যে অর্ধেক পরিবার পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গেছেন।

তাড়াশ উপজেলার হামকুড়িয়া গ্রামের চাঁই তৈরির করিগর নাছির উদ্দিন ছালেকা বেগম দম্পতির সঙ্গে কথা হয়। তারা জানান তাদের বর্তমান ও অতীতের সুখ-দুঃখের নানা কাহিনী। চাঁই বানানো তার বাপ-দাদার পেশা। এটি প্রায় একশ’ বছরের ঐতিহ্য। ছোট বয়স থেকেই বাবার হাত ধরে চাঁই বানানোর প্রশিক্ষণ নেন নাছির উদ্দিন। তারা বলেন, বাঁশ দিয়ে নিপুণ হাতে তৈরি করা চাঁই এক সময় কদর ছিলো। এখন আর সে কদর নেই। তাদের পৈত্রিক পেশা ছিলো এটা। এই চাঁই তৈরি করেই তাদের চার সদস্যের সংসার চলতো ভালো ভাবেই। কিন্তু বর্তমানের চাঁইয়ের চাহিদা ও বাজারে দাম না থাকায় সংসারের চাহিদা মিটাতে নাছির উদ্দিন অন্যত্র দিন মুজুরি কাজ করছেন। আর তার স্ত্রী ঘরে বসে চাঁই তৈরি করছেন। তারা মনে করছেন গ্রামবাংলার ঐতিহ্য মাছ ধরার ফাঁদ চাঁই আগামী ২-৩ বছর পর আর পাওয়া যাবে না। এ পেশা ও চাঁই বিলুপ্ত হওয়ার পথে।

চাঁই তৈরির নিপুণ হাতের কারিগররা এখন পেশা পাল্টিয়ে অন্য পেশায় ঢুকে পড়ছেন। এখন চাঁই হাটে-বাজারে তেমন আর বিক্রি করতেও দেখা যায় না। তবে চলনবিলের চাঁই বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ চাটমোহর রেল বাজার, চাঁচকৈড়, কাছিকাটা, নয়াবাজার, সিংড়া, নওগাঁ, মির্জাপুর, সলঙ্গাসহ ১০ থেকে ১৫ টি হাটে চলনবিল অঞ্চলে তৈরি চাঁই, খোলসুন, ধুন্দি, ভাইর, বিত্তিসহ নানা রকমের মাছ শিকারের উপকরন খুরচা ও পাইকারি এখনো বিক্রি হচ্ছে।

চলনবিল এলাকায় তৈরি চাঁইয়ের গুনগতমান ভালো থাকায় বর্ষা মৌসুমে চলনবিল এলাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে যেমন চট্টগ্রাম, বরিশাল, নোয়াখালি, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধার পাইকাররা কিনে ট্রাক ভর্তি করে নিয়ে যাচ্ছেন তাদের এলাকায়।
বৃহস্পতিবার (২০ জুলাই) তাড়াশ নওগাঁ হাঁটে গুরুদাসপুর থেকে আসা চাঁই বিক্রেতা জামাল উদ্দিন বলেন, বর্তমান বাজারে প্রতিটি স্বাভাবিক মাপের চাঁই খুচরা ৩০০ থেকে ৩৫০ এবং বড় চাঁই (বিত্তি) প্রকার ভেদে ৪০০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, গত কয়েক বছরে চাঁইয়ের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। তবে বর্তমানে নিষিদ্ধ চায়না জাল বাজারে আসায় আগের চেয়ে চাঁই বিক্রি অনেকটাই কম। তারপরও চলনবিলের সৌখিন ও মৎস্য শিকারিরা চাঁই কিনে বাড়ি ফিরছেন।

চাঁই তৈরির কারিগরদের আশঙ্কা ২-৩ বছরই হয়তো পুঁজি হারাতে হতে পারে এ পেশাজীবীদের। আগামী বছর এ পেশাটি টিকবে কি না তাও জানেন না তারা। ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প চাঁই তৈরির পেশায় এখনো অনেকেই টিকে আছেন। তারা এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন যদি সরকারি কোন সাহায্য সহযোগীতা পাই ও নিষিদ্ধ চায়না জাল বন্ধ করা হয় তাহলে আবারও এ পেশাটি ঘুরে দাঁড়াবে।

সম্পাদক ও প্রকাশক মোঃ রফিকুল ইসলাম রনি-০১৭১৩-৫৮২৪০৬, নির্বাহী সম্পাদক মোঃ রায়হান আলী-০১৭৫১-১৫৫৪৫৫, বার্তা সম্পাদক মোঃ সিরাজুল ইসলাম আপন-০১৭৪০-৩২১৬৮১। বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়ঃ মেছের উদ্দিন সুপার মার্কেট ভবন, হান্ডিয়াল বাজার, চাটমোহর, পাবনা থেকে প্রকাশিত। ঢাকা অফিসঃ তুষারধারা, আর/এ, সেক্টর ১১, রোড নং ০৭, যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১৩৬২। বার্তা কার্যালয়ঃ অষ্টমনিষা বাজার, ভাঙ্গুড়া, পাবনা। প্রকাশক কর্তৃক সজল আর্ট প্রেস, রূপকথা গলি, পাবনা থেকে মুদ্রিত। মোবাইল নম্বর-০১৭৪৯-০২২৯২২,ই-মেইল- newscbalo@gmail.com / editorcbalo@gmail.com / www.chalonbileralo.com

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার সম্পূর্ণ বেআইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ ©2017-2025 (এটি গণপ্রজাতন্ত্রি বাংলাদেশ সরকার অনুমোদিত সাপ্তাহিক চলনবিলের আলো পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ) অনলাইন নিবন্ধন আবেদনকৃত। আবেদন নম্বর- ২১৮৮।