রুবিনা আজাদ, আঞ্চলিক প্রতিনিধি, বরিশাল:
করোনার ক্রান্তি লগ্ন থেকে অদ্যাবধি বরিশালে বিদ্যুত চালিত অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে বন্ধ। এছাড়া অধিকাংশ শপিংমলসহ ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান বিকেল চারটার পর থেকে বন্ধ হয়ে গেলেও থেমে নেই প্রতিঘন্টায় লোডশেডিংয়ের নামে বিদ্যুতের ভানুমতির খেলা।
নগরীসহ জেলার প্রায় প্রতিটি উপজেলায় গত একমাস ধরে পিক-অকপিক আওয়ারে বিদ্যুতের এ ভেলকিবাজিতে ওষ্ঠাগত গরমে জনজীবনে চরম অশান্তি নেমে আসলেও বিষয়টি যেন দেখার কেউ নেই। বরিশালে বিদ্যুতচালিত শিল্প প্রতিষ্ঠান পুরোপুরি ও শপিংমলসহ ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান বিকেল চারটার পর থেকে বন্ধ থাকা সত্বেও দিন-রাত সমানতালে প্রতিঘন্টায় লোডশেডিংয়ের কারণ সম্পর্কে বলতে পারছেন না সাধারণ গ্রাহকরা।
তাদের দাবি করোনার আগে এমনটা হয়নি। বর্তমানে বিদ্যুতচালিত বড় বড় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের কোন ঘাটতি থাকার কথা নয়; তারপরেও আগের চেয়ে এখন লোডশেডিং অনেকাংশে বেড়ে গেছে। গ্রাহকদের অভিযোগ বিষয়গুলো যারা দেখবেন, বরিশালের নেতৃত্বস্থানীয় সেইসব জনপ্রতিনিধিরা করোনার ভয়ে দীর্ঘদিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকায় একপ্রকার অভিভাবক শূন্য হয়ে পরেছে গোটা বরিশাল। সেই সুযোগে বিদ্যুত বিভাগ মনগড়াভাবে তাদের খেয়াল খুশিমতো বিদ্যুত সরবরাহ করলেও গ্রাহকদের চরম দুর্ভোগের বিষয়গুলো দেখার কেউ নেই।
যেকারণে লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি বরিশাল নগরীসহ গোটা বরিশাল জেলায় করোনার মধ্যেও বিদ্যুৎ বিল কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে গ্রাহকদের বাসা-বাড়িতে বিলের কাগজ বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে ভুতুরে বিদ্যুত বিলের বিষয়টি নিয়েও চরম বিপাকে পরেছেন কয়েক লাখ গ্রাহক।
বরিশাল সিটি কর্পোরেশন এলাকার বেশিরভাগ জায়গায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো)। তাদের দুটি বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রের আওতায় নগরীতে এক লাখ পনেরো হাজার গ্রাহক রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ মে মাসের বিল নিয়ে নানা অভিযোগ রয়েছে এসব গ্রাহকদের।
নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ইউসুফ হাওলাদার ২নং বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রের গ্রাহক। গত কয়েকবছর যাবৎ তার মাসিক বিদ্যুৎ বিল আসে দুই থেকে তিনশ’ টাকার মধ্যে। কিন্তু সর্বশেষ মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রতি মাসে তার বিল এসেছে চারশ’ টাকার উপরে। তিনি নিশ্চিত করে বলেন, এইসময়ে তার বাড়িতে নতুন কোন ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার করা হয়নি যাতে বিল বাড়তে পারে। বরং করোনাকালীন সংকটের সময়ে বিদ্যুৎ বিল কমানোর জন্য প্রয়োজন থাকা সত্বেও ঘরের লাইট কিংবা ফ্যান প্রায়ই বন্ধ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, বিল বেশি কেন এসেছে সে প্রশ্ন বড় কর্মকর্তাদের করার সাহস নেই। তাই করোনায় আর্থিক সমস্যার মধ্যে ঝামেলা এড়াতে প্রতিমাসে দ্বিগুণ হারে বিল পরিশোধ করে আসছি। একই অভিযোগে নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডের বিদ্যুত গ্রাহকদের।
বরিশাল ওজোপাডিকোর বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্র-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী অমূল্য কুমার সরকার জানান, গত এপ্রিল ও মে মাসজুড়ে করোনা পরিস্থিতি খারাপ থাকায় তাদের কর্মীরা বাসায় বাসায় গিয়ে মিটার রিডিং (পরীক্ষা) করে বিল করতে পারেন নি। এ কারণে কিছু ভুল হতে পারে। কিন্তু যারাই বিলের ব্যাপারে অভিযোগ করেছেন তাদের বিষয়ে সমাধানমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
ওজোপাডিকো-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আমজাদ হোসেন বলেন, আমার মাঠকর্মী (লাইনম্যান) ২০ জন। তারাই সাধারণত মিটার রিডিংয়ের কাজ করেন। কিন্তু সাধারণ বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ করতে গিয়ে তাদের অধিকাংশ করোনা উপসর্গ নিয়ে আইসোলেশন অবস্থায় বাড়িতে আটকে পরেছেন। জনবল সংকটের কারণে যেভাবে বিল করার কথা সেভাবে করার উপায় ছিলোনা। যে কারণে মিটার রেটিং ধারণা করে বিল করতে গিয়ে কিছু সমস্যা হতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশাল নগরীর বাহিরে প্রায় প্রতিটি উপজেলায় পল্লী বিদ্যুতের অবস্থা আরও ভংয়ঙ্কর। ভূতুরে বিল প্রদানের ব্যাপারে তারা রয়েছেন সবার উপরে। গৌরনদী পৌর এলাকার গেরাকুল মহল্লার পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক এম. গোলাম খোকন অভিযোগ করে বলেন, তার আবাসিক ভবনে গত এপ্রিল মাসের বিল আগে ১১শ’ ৫৪ টাকা, মে মাসের বিল আসে ২৫শ’ ৯৪ টাকা, সেই একই ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহার করে জুন মাসের বিল আসে ৩৭শ’ ৭৯ টাকা। এটা যেন করোনার মধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা।
ইতোমধ্যে বরিশাল নগরীসহ জেলার প্রতিটি উপজেলার বিদ্যুত গ্রাহকদের দেয়া ভুতুরে বিল প্রত্যাহারের দাবিতে সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে বাসদ’র জেলা শাখার সদস্য সচিব ডাঃ মনিষা চক্রবর্তী বলেন, বিদ্যুত বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বক্তব্যে তাদের দুর্নীতির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কারণ একজন গ্রাহকের এক মাসে যে বৈদ্যুতিক বিল আসে, সেটা হঠাৎ করে পরের মাসে দ্বিগুণ বা তিনগুণ হতে পারেনা। করোনা দুর্যোগের সময় যেখানে সরকারের উচিত মানুষের এ ধরনের খরচ থেকে মুক্তি দেয়া, সেখানে বিদ্যুত বিভাগের ভুতুরে বিলের ঘটনা সাধারণ মানুষদের রক্ত চোষার সামিল।
তিনি আরও বলেন, গ্রাহকরা বিদ্যুত অফিসে গিয়ে কোন অভিযোগ দেবেনা, বরং বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে অনতিবিলম্বে যদি ভুতুরে বিলের ঘটনার ফয়সালা না করেন, তবে আমরা পুরো বরিশালের গ্রাহকদের নিয়ে বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাওসহ দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলবো।
সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) জেলা সভাপতি প্রফেসর শাহ সাজেদা বলেন, সরকার থেকে ঘোষণা এসেছিলো করোনাকালীন সময়ে বকেয়া বিদ্যুৎ বিলের জন্য কোনোরকম বিলম্ব ফি জনগণকে দিতে হবেনা। কিন্তু বিদ্যুত বিভাগের বিরুদ্ধে বিলম্ব ফি মওকুফ না করাসহ মিটার রিডিং না দেখেই ভুতুরে বিল করে গ্রাহকের বাসা-বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ ব্যাপারে আমরা বিদ্যুত বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের স্পষ্ট বক্তব্য ও ভুতুরে বিল স্থগিতের দাবি করছি।