দশবছর আগেও কেউ যা কল্পনা করতে পারেননি তাই যেন বাস্তবে দেখছেন দেশের মানুষ। ‘বিদ্যুত যায় না মাঝে মাঝে আসে’ এমন প্রচলিত কৌতুকেই যেন অভ্যস্ত ছিলেন দেশবাসী। কিন্তু মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে শতভাগ বিদ্যুতায়িত হলো বাংলাদেশ। দেশের প্রায় সব জায়গায় পৌঁছে গেছে বিদ্যুতের আলো। যেসব দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের লাইন নেয়া সম্ভব হয়নি সেগুলোও সোলার সিস্টেম বা সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে হয়েছে আলোকিত। মুজিববর্ষকে সামনে রেখে শতভাগ বিদ্যুতায়নের যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল তার বাস্তবায়নে যেন আলোর ঝর্ণাধারায় ভাসছে দেশ। এতে করে গ্রামীণ জনজীবনে যেমন এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন তেমনি নগর জীবনে বিশেষ করে শিল্প-কারখানায় বেড়েছে উৎপাদন। ফলে এসেছে অর্থনীতিতে আশাতীত সাফল্য। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ ধারা অব্যাহত রাখতে হলে বিদ্যুতের সহজলভ্যতা এবং নিরবচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে সিস্টেম লসের দৌরাত্ম্য থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বিদ্যুত খাত থেকে। তবেই পৌঁছানো যাবে সাফল্যের চূড়ায়।
বিদ্যুত বিভাগ সূত্র জানায়, গত ১২ বছরে দেশে বিদ্যুত কেন্দ্রের সংখ্যা ২৭টি থেকে বেড়ে হয়েছে ১৪৬টি। যার মধ্যে বন্ধ হয়েছে মাত্র ৪টি কেন্দ্র। যেগুলোর উৎপাদন দক্ষতা শূন্যের কোঠায় ছিল। এসব কেন্দ্রে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। একদিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুত উৎপাদিত হয়েছে ১২ হাজার ৭৯২ মেগাওয়াটে। জানা যায়, ২০০৯ সাল থেকে ২০২০ সালে সঞ্চালন লাইন ৮ হাজার কিলোমিটার থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৮৩৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে গ্রিড সাবস্টেশন ক্ষমতা ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হাজার ৩৫৯ এমভিএ। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিদ্যুত আমদানি শূন্যের কোঠায় থাকলেও ২০২১ সালে এসে বিদ্যুত আমদানি হয়েছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। বিস্তৃত হয়েছে বিতরণ লাইনেরও। ২০০৯ সালে যে লাইনের দৈর্ঘ্য ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ১২ হাজারে। এই সময়ে বিদ্যুত সুবিধার আওতায় এসেছেন ৯৯.৫০ শতাংশ মানুষ। যে কয়টি জায়গায় বাকি আছে তা একেবারেই নতুন করে তৈরি হচ্ছে বলে দাবি বিদ্যুত বিভাগের।
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডও (বিআরইবি) বলছে, বিদ্যুতের সেবা পৌঁছে গেছে জাতীয় গ্রিডের আওতায় থাকা সব গ্রাম ও পরিবারে। গ্রিড এলাকার বাইরে থাকা সব দুর্গম এলাকার বাসিন্দারাও পেয়েছেন বিদ্যুতের আলো। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুত’ এ স্লোগান সামনে রেখে সবার জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুত সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল মানুষ ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছেন। ফলে আর নতুন তৈরি হওয়া কিছু ঘর-বাড়ি ছাড়া দেশের সব জায়গায়ই বিদ্যুতায়িত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু যে আলোকিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন তা তার জন্মশতবার্ষিকীতে পূর্ণ হলো। বিদ্যুত এবং জ্বালানিতে এত দ্রুত স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে যে কল্পনাতীত। আর এর কারণেই দেশের অর্থনীতি এত দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। ২০০৮’র নির্বাচনী ইশতেহারে অঙ্গীকার ছিল সবার জন্য বিদ্যুত। ২০২১-এ তা আজ বাস্তব। যেসব এলাকায় বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর সুযোগ নেই সেসব এলাকাতেও আমরা বিদ্যুত পৌঁছে দিয়েছি সোলার বা সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুতের ছোঁয়ায় মানুষের জনজীবনে এসেছে গতি। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষজনের দিন আগে সন্ধ্যার মধ্যেই ফুরিয়ে যেত। এখন বিদ্যুতের আলো পৌঁছায় রাত ১২টা পর্যন্ত গ্রামগুলোতেও দোকানপাট, হাট-বাজার খোলা থাকে। রাত জেগে পড়ালেখা করতে পারছে শিক্ষার্থীরা। শুধু গ্রামীণ জীবন নয়। নগর জীবনেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। বিশেষ করে শিল্প-কারখানাগুলোতে বিদ্যুত এবং জ্বালানির সরবরাহ বাড়ায় বেড়েছে উৎপাদন। ফলে অর্থনীতিতে এসেছে সমৃদ্ধি। এই যে অর্থনীতির এই ধারাবাহিক উন্নয়ন তা সম্ভব হয়েছে একমাত্র বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের অভূতপূর্ব উন্নয়নের কারণেই। তিনি বলেন, তবে আমাদের এখনও কাজ করতে হবে। এই বিদ্যুত সহজলভ্য এবং নিরবচ্ছিন্ন করতে কাজ করে যাচ্ছি আমরা। প্রি-পেইড মিটার বসানো থেকে শুরু করে সহনীয় দামে মানুষের কাছে বিদ্যুতসেবা পৌঁছে দিতে কাজ করছি আমরা। আর এখন এটাই অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
বিদ্যুত এবং জ্বালানি খাতের এই ঈর্ষণীয় সাফল্যের সূচনা হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়কালে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে বিদ্যুত-জ্বালানি খাতে একটি শক্ত ভিত্তি দিতে সক্ষম হন। তার নির্মম হত্যাকান্ডের পর এই খাতটি দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় ডুবে যায়। তবে ১৯৯৬ সালে তার কন্যার হাত ধরে জ্বালানি ও বিদ্যুত খাতে নতুন ধারার সূচনা হলেও আবার ছন্দপতন ঘটে। এই খাতে অনেক অর্জন হলেও বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে নিজস্ব জ্বালানি সম্পদকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া যায়নি। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন। তবে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, শুধু কৃষি দিয়ে তা হবে না। শিল্প-কারখানা লাগবে। বিদ্যুত লাগবে। বিদ্যুতের জন্য তেল গ্যাস কয়লা লাগবে। গ্যাসক্ষেত্র কেনার পাশাপাশি গ্যাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মতে, দেশে ১০ লাখ ইউনিট বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধি পেলে তার প্রভাব সামষ্টিক অর্থনীতিতেও পড়ে। এতে অর্থনীতিতে বাড়তি যোগ হয় প্রায় ৪ কোটি ৬০ লাখ থেকে ১০ কোটি ৭০ লাখ টাকা। শতভাগ বিদ্যুতায়নের সুফল শুধু সাধারণ মানুষ নন দেশের সব শ্রেণীর মানুষই ভোগ করছেন বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি)’র কান্ট্রি ইকোনমিস্ট।
#চলনবিলের আলো / আপন