প্রাকৃতিক জলাশয়ের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়ায় এবং নির্বিচারে মাছ নিধনের ফলে ক্রমেই সংকটাপন্ন হয়ে উঠছে দেশি মাছ। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলার ঐতিহ্যবাহী শুঁটকি শিল্পে। এক সময় বর্ষা শেষে যে শুঁটকি চাতালগুলো কর্মচাঞ্চল্যে মুখর থাকত, সেখানে এখন নীরবতা। দেশি মাছের অভাবে বন্ধ হয়ে গেছে অধিকাংশ শুঁটকি চাতাল।
স্থানীয়দের মতে, নদী ও খাল-বিলের স্বাভাবিক চলন নষ্ট হওয়ায় জলাশয়ে পানি ধারণ ক্ষমতা কমে গেছে। অপরিকল্পিত বাঁধ, সড়ক ও বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের ফলে বিলগুলো বর্ষা মৌসুমেও পুরোপুরি পানিতে ভরে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চায়না দুয়ারি, বাদাই জালসহ নিষিদ্ধ বিভিন্ন জাল দিয়ে নির্বিচারে মাছ শিকার। এতে মা মাছের পাশাপাশি রেণু ও পোনা মাছও ধ্বংস হচ্ছে, ফলে প্রাকৃতিকভাবে মাছের বংশবিস্তাার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
মৎস্য সংশ্লিষ্টরা জানান, ভাঙ্গুড়ার মুক্ত জলাশয় ও চলনবিল এলাকায় এক সময় মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, চিতল, রিটা, গুজি, আইড়, কৈ, বোয়াল, খৈলসা, দেশি সরপুঁটি, গজার, বাইম, টাটকিনি, তিতপুঁটি, বাঘাইড়, গুলশা, কাজলি, গাং চেলা, টেংরা, মলা, কালোবাউশ ও শোলসহ অন্তত ৩০ থেকে ৪০ প্রজাতির দেশি মাছ পাওয়া যেত। বর্তমানে এসব মাছ বিলুপ্তির পথে। বাজার ঘুরে চাষের মাছ ছাড়া দেশি মাছ প্রায় অনুপস্থিত।
নদী ও বিলপাড়ের বাসিন্দা আব্দুল জলিল ও দিলবার হোসেনসহ কথা হয় বেশ কয়েক জনের সাথে। তারা জানান, একসময় বর্ষা মৌসুমে চলনবিলসহ ভাঙ্গুড়ার ছোট-বড় সব বিল পানিতে থইথই করত। তখন উঁচু জমিতে ফসল আবাদ হতো এবং নদী-খালে চলত মাছ শিকার। সেই মাছ দিয়েই সচল থাকত শুঁটকি চাতালগুলো। ভাঙ্গুড়ার শুঁটকি একসময় দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশের অন্তত ২০টি দেশে রপ্তানি হতো। কিন্তু জলাশয়ে পানি কমে যাওয়া এবং দেশি মাছ কমে যাওয়ায় এখন সেই রপ্তানি কার্যক্রমেও ভাটা পড়েছে।
সম্প্রতি ভাঙ্গুড়া উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ শুঁটকি চাতাল বন্ধ। একটি খোলা আছে, সেটাতেও উৎপাদন খুবই সীমিত। ফলে চাতালগুলো হারাচ্ছে তাদের পুরনো আমেজ। শুঁটকি উৎপাদন কমে যাওয়ায় আয় হারাচ্ছেন শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা।
শুঁটকি চাতালেন শ্রমিক আলিয়া খাতুন বলেন, “আগে চাতালে কাজের অভাব ছিল না। প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় হতো। এখন মাছ না থাকায় অধিকাংশ দিন কাজই থাকে না। সংসার চালানো কষ্ট হয়ে গেছে।”
শুঁটকি ব্যবসায়ী আনছার আলী জানান, আগে নিয়মিতভাবে মাছ পাওয়া গেলেও এ মৌসুমে অনেকেই টানা দুই সপ্তাহেও মাছ পাননি। অনেক ব্যবসায়ী বাধ্য হয়ে চাতাল পুরোপুরি বন্ধ রেখেছেন। তাদের অভিযোগ, চলনবিল এলাকায় অপরিকল্পিত পুকুর খনন, অবৈধ জাল স্থাপন এবং অবাধ মাছ শিকার পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
ভাঙ্গুড়া উপজেলার কলকতির শুঁটকি চাতালের মালিক মো: দুলাল হোসেন বলেন, “দিলপাশার, পুইবিল, আদাবাড়িয়া, বাশবাড়িয়া ও দত্তখারুয়া বিলে একসময় প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেত। এখন চায়না দুয়ারি জাল দিয়ে মা মাছসহ সব ধ্বংস করা হচ্ছে। এতে দেশি মাছের উৎপাদন ও প্রজনন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। শুঁটকি উৎপাদন ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।”
এ বিষয়ে ভাঙ্গুড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আলী আজম বলেন, “চায়না দুয়ারিসহ বিভিন্ন নিষিদ্ধ জালে নির্বিচারে মাছ নিধন এবং বৃষ্টি কম হওয়ায় জলাশয়ে পানি ও মাছ দুটোই কমেছে। অন্যান্য বছর যেখানে তিনটি শুঁটকি চাতাল ছিল, সেখানে এবার রয়েছে মাত্র একটি। গত বছর ১৩ টন শুঁটকি উৎপাদন হলেও এ বছর ৫ থেকে ৭ টন উৎপাদন করাও কঠিন।”
তিনি আরও বলেন, দেশি ও বিদেশি বাজারে শুঁটকির চাহিদা থাকলেও জলাশয়ে পর্যাপ্ত মাছ না থাকলে এই শিল্প টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এজন্য নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার বন্ধ, জলাশয়ের স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা এবং মৎস্যজীবীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে নিয়মিত অভিযান ও আইন প্রয়োগ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।