বাংলাদেশের দুধের রাজধানী হিসেবে পরিচিত পাবনার ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুর উপজেলা। চলনবিল অধ্যুষিত এ অঞ্চল থেকে প্রতিদিন উৎপাদিত হয় কয়েক লাখ লিটার দুধ। কিন্তু এই বিশাল বাজারের আড়ালে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর নকল দুধের একটি সিন্ডিকেট, যারা দুধের নামে বাজারে ছাড়ছে রাসায়নিক মিশিয়ে বানানো সাদা বিষ। প্রতিবেদকের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এই অবৈধ কারবারের চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, শুধু মাত্র পাবনার ভাঙ্গুড়া উপজেলায় গো-খামারী আছেন ৪ হাজার ৮৯০ জন, যারা প্রতিদিন উৎপাদন করেন প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার ৭০০ লিটার খাঁটি দুধ।
অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, ভাঙ্গুড়া, চাটমোহর ও ফরিদপুরে শতাধিক গোপন কারখানা চলছে দীর্ঘদিন ধরে। ছোট ছোট বাড়ি, ঘরের বারান্দা, মাচা বা খালি দোকানঘরেই তৈরি হয় এসব নকল দুধ। এই নকল দুধ সরবরাহ করা হয় সরাসরি বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির চিলিং সেন্টারে। শুধু ভাঙ্গুড়াতেই রয়েছে নামে বেনামে প্রায় অর্ধ শতাধিক চিলিং সেন্টার। যার মধ্যে ২৭ টি নামিদামি কোম্পানির এবং বাকিগুলো ব্যক্তি পরিচালিত। যার প্রায় কোনটিতেই মান নিয়ন্ত্রণের নিয়ম ঠিকভাবে মানা হয় না। কেননা দুধ সংগ্রহে প্রতিযোগিতার কারণে কারও ‘না’ বলার সুযোগ নেই।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে এই নকল দুধের এক কারবারী সহযোগিতা করেন প্রতিবেদককে। তিনি জানান, ননী ফ্যাট তুলে নেওয়া পাতলা দুধ বা পানি মিশিয়ে তাতে যোগ করা হয় সয়াবিন তেল, গ্লুকোজ, স্যাকারিন, ইউরিয়া, ডিটারজেন্ট পাউডার, কস্টিক সোডা, অজ্ঞাত উৎসের রাসায়নিক জেলি। এসব উপাদান ব্লেন্ডারে মিশিয়েই কয়েক মিনিটে তৈরি করা হয় দেখতে খাঁটি দুধের মতো সাদা তরল।
তিনি আরও জানান, ঢাকার একটি সিন্ডিকেট কুরিয়ারে পাঠায় এসব কেমিক্যাল। শুন্য ফ্যাটবিশিষ্ট ৪০ লিটার দুধে মাত্র ৪৫০ টাকার এসব রাসায়নিক মিশ্রণ দিলেই তৈরি হয়ে যায় ‘উচ্চ ফ্যাটযুক্ত’ দুধ। যা বিক্রি করা হয় প্রায় ২২০০ টাকা। এতে করে প্রতি ৪০ লিটার দুধে বাড়তি আয় হয় ১৭৫০ টাকা।
আপনাদের এই নকল দুধ দেশের নামিদামি সিলিং সেন্টার গুলোতে নেয় কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, প্রতি ৪০ লিটার দুধের জন্য সিলিং সেন্টারের কর্তব্যরত কর্মকর্তাকে ৫০০ টাকা করে দিতে হয় আমাদের। যদি এই টাকাটা না দেই তাহলে আমাদের এই নকল দুধ তারা নেয় না। টাকা দিলে আর কোন সমস্যাই থাকে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, চলতি বছরের ২২ জুলাই চাটমোহর উপজেলার ছাইকোলা ইউনিয়নের নাঙ্গলমোড়া গ্রামে প্রাণ কোম্পানির হাব সেন্টারে অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে জব্দ করা হয় কয়েক হাজার লিটার নকল দুধ, তেল, কেমিক্যাল, রাসায়নিক ড্রাম। ঘটনাস্থলেই ৩ কর্মকর্তাকে ছয় মাসের কারাদন্ড দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।
এছাড়াও চলতি বছরের ২০ সেপ্টেম্বর ভাঙ্গুড়া উপজেলার মেন্দা খালপাড় এলাকায় পুলিশ অভিযানে পায় একটি নকল দুধ কারখানা। বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করা হলেও মালিক পালিয়ে যায়। পরদিন ভাঙ্গুড়া থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলার পর অভিযুক্তরা আদালতে হাজির হলে তাদের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়।
অনুসন্ধানের সময় সাংবাদিক পরিচয়ে জানতে চাইলে জগাতলা আকিজ চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা অভিযোগ অস্বীকার করেন।
রাঙ্গালিয়া প্রাণ ডেইরির কর্মকর্তা কোনো বক্তব্য দিতে চাননি।
জগাতলা আড়ং ডেইরির চিলিং সেন্টারের কর্মকর্তা চিলিং সেন্টার ও ল্যাবে তালা ঝুলিয়ে পালিয়ে যান।
এ বিষয়ে কথা হয় খামারি আব্দুল খালেক ও খামারি রহিম উদ্দিনের সাথে। তারা জানান, আমরা দিনরাত খাটাখাটনি করে দুধ উৎপাদন করি। নকল দুধ কম দামে চিলিং সেন্টারে ঢুকে যাচ্ছে। আমরা খাঁটি দুধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও দাম পাওয়া যায় না। এভাবে চললে আমাদের খামার বন্ধ করতে হবে।
উপজেলা দুগ্ধ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. শামীম আহমেদ জানান, আমাদের অনেক সৎ ব্যবসায়ী নকল দুধের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চিলিং সেন্টারগুলোর মান নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা ছাড়া সমাধান নেই। প্রশাসনকে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে তা না হলে দুধ শিল্প পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
ভাঙ্গুড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি মো. রায়হান আলী বলেন, এ অঞ্চলের দুধ শিল্প পুরোপুরি ধ্বংসের মুখে। সাংবাদিকরা বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে সামনে আনলেও বড় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। নকল দুধ চক্র এতই শক্তিশালী যে তারা প্রশাসনকেও প্রভাবিত করতে পারে।
ভাঙ্গুড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. শহিদুজ্জামান তরুণ বলেন, নকল দুধ চক্রের মূল শক্তি তাদের পেছনে থাকা প্রভাবশালীরা। নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি জড়িতদের সম্পদের উৎস অনুসন্ধান ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া জরুরি। নইলে এই চক্র ভাঙা সম্ভব নয়।
ভাঙ্গুড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. হালিমা খানম জানান, এই নকল দুধ দীর্ঘমেয়াদে ক্যানসার, অঙ্গ বিকল, শিশুর বিকাশগত সমস্যা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। জনগণকে সতর্কতার পাশাপাশি প্রশাসনকে জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স স্যানিটারি ইন্সপেক্টর মো. নূরুল ইসলাম বলেন, ডিটারজেন্ট, কস্টিক সোডা, ইউরিয়া ও শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত কেমিক্যাল মানুষের শরীরে স্থায়ী ক্ষতি করতে পারে। বিশেষ করে শিশুদের কিডনি, লিভার ও হরমোন সিস্টেমের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। নকল দুধ এক ফোঁটাও নিরাপদ নয়। এদের বিরুদ্ধে নিয়মিত আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।
চলনবিলের সুনামঘেরা দুধ শিল্পকে গ্রাস করছে এক ভয়ংকর চক্র। খামারি, ভোক্তা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য রক্ষায় এখনই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কঠোর পদক্ষেপ। অন্যথায় দুধের বদলে বিষই পান করবে মানুষ। আর নকল দুধের এই সাম্রাজ্য হয়ে উঠবে আরও ভয়ংকর।