২০০৬ সালে ষষ্ঠ শ্রেনীতে পড়ার সময় শ্যামনগরের দরিদ্র রিকশাচালক ফিরোজ হোসেন ডান পায়ে ফ্যাকাশে কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করেন। গুরুত্ব না দেয়ায় প্রায় তিনমাস পর জিনিসটা আরও বেড়ে যায়।স্থানীয় গ্রাম ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে চর্মরোগের চিকিৎসা করা হয়। এতেও ভালো না হয়ে সেখান থেকে গুটি বের হয় এবং আস্তে আস্তে পা অবশ হয়ে যায়। এরপর তিনি খুলনা ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি হলে পরীক্ষা ছাড়াই চর্মরোগের চিকিৎসা করা হয় এবং একপর্যায়ে তার ডান পা কেটে ফেলা হয়।
এরকম ঘটনা শুধু ফিরোজ হাসানেরই নয়। শ্যামনগরের অশ্বিনী মুন্ডাও হয়ে গেছেন প্রতিবন্ধী। ১৯৭০ সালে শ্যামনগরের অশ্বিনী মুন্ডা দুই হাতে ফ্যাকাশে কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করেন। ধীরে ধীরে জায়গাটি অবশ হয়ে যেতে থাকে এবং গুটি উঠতে থাকে। স্থানীয় গ্রাম ডাক্তারের পরামর্শে তিনি সেগুলো কেটে ফেলেন। এর কিছুদিন পর থেকেই হাত অবশ হয়ে যায় এবং কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়েন অশ্বিনী মুন্ডা। ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া ও তারপর গুটি উঠে অবশ হয়ে যাওয়া রোগটির নাম কুষ্ঠ। কুষ্ঠ রোগ মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাচীন হলেও দেশে এই রোগ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রায় নেই বললেই চলে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য প্রতি ১০ হাজারে কুষ্ঠ রোগীর সংখ্যা কমিয়ে একজনের নিচে নিয়ে আসা। সেই অনুযায়ী বাংলাদেশ ১৯৯৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্য পূরন করলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো বলছে, এখনও প্রতিবছর চার হাজার মানুষ নতুন করে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র অনুযায়ী, আশির দশকে সারাদেশে ১০ থেকে ১১ হাজার কুষ্ঠ রোগী শনাক্ত হয়েছে। ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছে ২ হাজার ৭২৪ জন। সরকারের লক্ষ্যমাত্রা হলো এই সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা।
সাতক্ষীরা জেলায় কুষ্ঠরোগীর সংখ্যা ২০২৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৬৮ জন। তবে এদের মধ্যে অনেকে সুস্থ হয়েছে। বর্তমানে চলমান স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া রোগীর সংখ্যা ৫১ জন। যার মধ্যে কালীগঞ্জে ৩৯ জন, আশাশনিতে ১১ জন ও সদরে একজন চিকিৎসাধীন রয়েছে। বেসরকারি এনজিও সংস্থা সিএসএস- এর মাধ্যমে রোগী শনাক্ত ও ওষুধ বিতরন করা হয় বলে জানান সাতক্ষীরা সিভিল সার্জন অফিস।
তবে কুষ্ঠ একটি দীর্ঘস্থায়ী সংক্রামক রোগ। এটি মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রে নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সৃষ্ট। এটি ত্বক, স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র চোখকে প্রভাবিত করে। ত্বকের সংবেদনশীলতা নষ্ট করে ও পেশীর দুর্বলতা তৈরি করে। তবে এটি নিরাময়যোগ্য। এই রোগের প্রথম ধাপে চিকিৎসা করা গেলে তা নিরাময় সম্ভব।
এছাড়া কুষ্ঠরোগীর কাছাকাছি বেশীক্ষণ থাকা, দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা, জিনগত প্রবনতা ও ভৌগলিক কারনে কুষ্ঠরোগ দেখা দেয়।
কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক লক্ষন হলো ত্বকের একটি অংশ সাদা ও অবশ হয়ে যাওয়া। দ্রুত চিকিৎসা করলে এটি নিরাময় করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,কুষ্ঠ রোগের প্রকোপ ও প্রতিবন্ধীতা শূন্যের কোঠায় আনতে করনীয় :
প্রাথমিকভাবে রোগ নির্ণয়ের পর মাল্টিড্রাগ থেরাপি প্রয়োগ, কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। ত্বকে বিকৃত ক্ষত, স্নায়ুর ক্ষতি, সংবেদনশীলতা হ্রাস বা পেশীর দুর্বলতা দেখা দিলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এছাড়া মাল্টিড্রাগ থেরাপি দিলে রোগী সুস্থ হয়ে যায় এবং রোগের বিস্তার বন্ধ হয়।
কুষ্ঠ ছড়ায় হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। তাই আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরী।
কুষ্ঠ একটি নিরাময়যোগ্য রোগ এবং সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হওয়া যায়—এই বার্তা সমাজের সকলের কাছে পৌছে দিতে হবে।কারন সমাজে কুসংস্কার রয়েছে যে, এই রোগ আর ভালো হয় না। এই রোগীর ছোয়া লাগলে তারও কুষ্ঠ হবে।
কুষ্ঠ রোগের প্রতিবন্ধিতার হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে মাল্টি-ড্রাগ থেরাপির সঠিক ব্যবহার এবং কুষ্ঠ আক্রান্তদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য ও কলঙ্ক দূর করা জরুরি।
কুষ্ঠ রোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেওয়া এবং কুষ্ঠের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। কুষ্ঠ রোগের সঠিক নির্ণয় ও দ্রুত মাল্টি-ড্রাগ থেরাপি (MDT) শুরু করলে প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই থেরাপিতে অ্যান্টিবায়োটিকের সংমিশ্রণ (ড্যাপসোন, রিফাম্পিসিন ও ক্লোফাজিমিন) ব্যবহার করা হয়। এছাড়া কুষ্ঠের কারণে হওয়া স্নায়বিক ক্ষতি এবং বিকৃতি প্রতিরোধের জন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
বেসরকারি সংস্থা সিএসএস এর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে সাতক্ষীরা দুই, বাগেরহাট ৫, ২০২০ সালে সাতক্ষীরা ১২, বাগেরহাট ০, ২০২১ সালে সাতক্ষীরা ২৯ বাগেরহাট ৩১, ২০২২ সালে সাতক্ষীরা ৫০, বাগেরহাট ৭৬, ২০২৩সালে সাতক্ষীরা ৪৯ বাগেরহাট ৯২, ২০২৪সালে সাতক্ষীরা ৬৮ জন বাগেরহাট ১০১, ২০২৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত সাতক্ষীরা ৩৫ ও বাগেরহাটে ৭৪ জন কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বেসরকারি সংস্থা সিএসএস এর প্রজেক্ট অফিসার মোঃ খালেকুজ্জামান বলেন,কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণে আমরা সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলার প্রতিটা উপজেলায় সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মশালা করেছি। রোগীদের চিহ্নিত করে বিনামূল্যে ঔষধের ব্যবস্থা করা হয়। তবে উপকূল উপজেলা শ্যামনগরে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোন কুষ্ঠ বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তা না থাকায় ভোগান্তিতে রয়েছে সেখানকার মানুষ।
জেলা সিভিল সার্জন মো: আব্দুস সালাম বলেন, সরকারিভাবে সিএসএস এনজিও’র মাধ্যমে রোগী শনাক্ত ও বিতরন করা হয়। এছাড়া এই কাজের জন্য প্রতিটি উপজেলায় সরকারি লোক নিয়োগ করা রয়েছে। চলতি মাস পর্যন্ত জেলায় ৫১ জন কুষ্ঠরোগী রয়েছে যাদের চিকিৎসা চলছে। এছাড়া কুষ্ঠরোগ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো ও আক্রান্ত ব্যক্তিরা যাতে সামাজিক হেনস্থার শিকার না হন সেজন্য সেমিনার, উঠান বৈঠক সহ নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়। এই কাজে বেসরকারি সংস্থা সিএসএস যথাযথভাবে সাহায্য করে থাকে।
আশাশুনি উপজেলার যক্ষা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সহকারী মো: আজহারুল ইসলাম জানান, চলতি মাসে সেখানে কোন রোগী নেই। কুষ্ঠরোগীর আক্রান্ত স্থান অবশ হলেই শুধুমাত্র চিকিৎসা দেয়া হয়। কুষ্ঠরোগী শনাক্তকরন কাজে খাদিজা নামের একটি মেয়ে কাজ করে।তবে আমাদের এখানে জনবল সংকট রয়েছে।