আমি একজন শিক্ষক। “শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড”—এই অমোঘ সত্যটি আমরা সবাই জানি। আর সেই মেরুদণ্ড গড়ে তোলার গুরু দায়িত্ব যাঁর হাতে থাকে, তিনি হলেন শিক্ষক। একজন শিক্ষক তাঁর জ্ঞান, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ দিয়ে একটি প্রজন্মকে গড়ে তোলেন। তিনি ছাত্রছাত্রীদের শুধু বইয়ের অক্ষর শেখান না; শেখান জীবনের দর্শন, মানবিকতা এবং দায়িত্ববোধ।
একজন শিক্ষকের অবদানেই একটি জাতি হয় শক্তিশালী, জ্ঞানসমৃদ্ধ এবং উন্নয়নের পথে অগ্রসর। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG-4) মানসম্মত শিক্ষার ওপর জোর দেয়, যা সরাসরি শিক্ষকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কারণ, মানসম্মত শিক্ষা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
“A great teacher is like a candle. It consumes itself to light the way for others.”
অর্থাৎ, একজন শিক্ষক মোমবাতির মতো, যিনি নিজেকে নিঃশেষ করে অন্যের পথ আলোকিত করেন।

১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি উদযাপন করা হয় শিক্ষকদের যথাযথ সম্মান ও স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা ও উন্নয়নে শিক্ষকদের অসামান্য অবদানকে স্মরণ করাই এই দিবসের মূল লক্ষ্য। বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে এটি পালিত হয়।
২০২৫ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হলো —

এই প্রতিপাদ্য বাংলাদেশের চলমান শিক্ষা সংস্কার এবং নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত সময়োপযোগী ও তাৎপর্যপূর্ণ। এখন সময় এসেছে শিক্ষকদের বিচ্ছিন্নতা দূর করে তাঁদের সম্মিলিত সহযোগিতায় রূপান্তরিত করার।
কারণ, একদল অনুপ্রাণিত ও সহযোগী শিক্ষকই পারেন একটি প্রজন্মকে গড়ে তুলতে।

বিশ্ব শিক্ষক দিবস ২০২৫ উপলক্ষে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গুণী শিক্ষক বাছাই কার্যক্রম শুরু করেছে, যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
বর্তমানে আমরা কাজ করছি দুইটি প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের নিয়ে—
জেন-জি (জন্ম: ১৯৯৭–২০১২)
আলফা প্রজন্ম (জন্ম: ২০১৩–বর্তমান)
এই প্রজন্ম প্রযুক্তির সঙ্গে বড় হচ্ছে। ফলে, তাদের শেখাতে হলে শিক্ষকদের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন অপরিহার্য।

দুঃখজনক হলেও সত্য, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম।
টিফিন ভাতা মাত্র ৬ টাকা!
অনেক শিক্ষক ব্যাংক ঋণে জর্জরিত।
এই অর্থনৈতিক চাপ শিক্ষকদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে, যা শিক্ষাদানের মানকেও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। এই বাস্তবতা মনে করিয়ে দেয় কবি আশরাফ সিদ্দিকী রচিত “তালেব মাস্টার” কবিতার সারমর্ম।

বিশেষ করে সহকারী শিক্ষকরা যেন এই ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বলির পাঠা।
সকাল ৯টায় বিদ্যালয়ে উপস্থিত হওয়া,
বিদ্যালয় পরিষ্কার রাখা,
ঘণ্টা বাজানো,
প্রশাসনিক কাজ করা,
আবার শ্রেণি পরিচালনা…
যে বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট রয়েছে, সেখানে তো কাজের পরিমাণ আরও দ্বিগুণ। নিয়মিতই আসছে নতুন নতুন পরিপত্র।
সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪:১৫ পর্যন্ত রুটিন দেখে মনে হয়, যেন প্রাথমিক শিক্ষকেরা রোবট!

আমি নিজে একটি শিক্ষক পরিবারে জন্মেছি। শিক্ষকদের জীবনযাত্রা ও সংগ্রাম আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি।
২০২৩ সালের ২৪ জানুয়ারি থেকে আমি ঘুনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
শিক্ষকতা এমন এক পেশা, যেখানে একবার ঢুকে গেলে শিশুদের মায়ার বাঁধনে আটকে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।
এমন এক ভালোবাসা ও দায়বদ্ধতার বন্ধন, যা অন্য কোনো পেশার মানুষ সহজে বুঝতে পারবেন না।
মনে পড়ে যায় কবি কাদের নেওয়াজ রচিত কালজয়ী “শিক্ষাগুরুর মর্যাদা” কবিতাটি।
তিনি লিখেছিলেন—
“শিক্ষক হলেন জাতির মেরুদণ্ড তথা সমাজ গঠনের মূল কারিগর।”

সত্যিই, কোনো শব্দ বা বাক্যে শিক্ষকের ভূমিকা, দায়িত্ব ও ত্যাগকে পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাগুরুর ঋণ কখনো শোধ করার নয়।

লেখক পরিচিতি:শুভঙ্কর সাহাসহকারী শিক্ষকঘুনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়নাগরপুর, টাঙ্গাইল।