বান্দরবানের সবচেয়ে দুর্গম উপজেলা থানচি। প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তবে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে হাসপাতালটি কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, এখানে ১২ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দু’জন। এর মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। ফলে কার্যত একজন চিকিৎসকের ওপরই ভরসা পুরো হাসপাতাল। নার্সের পদে ১৮ জন থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র চারজন। মিডওয়াইফ নেই একজনও।
স্থানীয়রা জানান, জটিল রোগ বা অন্তঃসত্ত্বা রোগীদের দ্রুতই বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান সদর হাসপাতালের দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। দুর্গম পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেক রোগী মাঝপথেই মারা যান।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত থানচি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার করা হয়েছে বান্দরবান সদর হাসপাতালে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী, আর রেফারের পথে মারা গেছেন অন্তত সাতজন। স্থানীয়দের দাবি, প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি।
তাদের অভিজ্ঞতা আলোকে এমন ভুক্তভোগী শৈসাইমং মারমা নামের নয় বছরের এক শিশু জানান, ২০২২ সালের নভেম্বর মাসে তার অন্তঃসত্ত্বা মা শৈমেপ্রু মারমাকে থানচি হাসপাতালে আনার পর সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়। কিন্তু পথে চিম্বুক এলাকায় মারা যান তিনি।
একইভাবে চার সন্তানের ‘মা’ লেংরু ম্রো হারালেন তার জীবনসঙ্গীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো কিডনি জটিলতায় থানচি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখান থেকে দ্রুত বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়, কিন্তু পথে থামার আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, চিকিৎসক সংকটে গর্ভবতী নারী, শিশু ও বয়স্ক রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। পাহাড়ি এলাকা থেকে নদীপথ কিংবা দুর্গম সড়ক পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে আসার পরও কাঙ্ক্ষিত সেবা না পেয়ে আবার সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়।
স্থানীয়রা দীর্ঘদিন ধরে থানচি হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যবস্থার সংকটের কথা বলছেন। মংমে মারমা জানান, হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসক, ঔষধ ও যন্ত্রপাতির অভাবে কার্যত অচল। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, বরং ডিপুটেশনে থেকে যান জেলা সদর হাসপাতালে। এর ফলে প্রায় ৩০ হাজার স্থানীয় মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
আরেক স্থানীয় বাসিন্দা রিয়েং ম্রো বলেন, পাহাড়ের অধিকাংশ মানুষ গরীব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল এবং কঠিন। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু এলাকার মানুষদের থানচি থেকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে প্রচুর খরচ হয়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার করা হলে সাধারণ মানুষ কিভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করবেন, তা এক বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়!
এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডাঃ মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ জানিয়েছেন, বর্তমানে উপজেলার ৫০ শয্যা হাসপাতালটিতে মাত্র দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। এর মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন থাকায় কার্যত রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে হাসপাতালের পুরো দায়িত্ব বর্তমানে একাই তিনি সামলাচ্ছেন।
ডাঃ মুরাদ আরও জানান, জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার করা ছাড়া উপায় নেই, কিন্তু দীর্ঘ পথের কারণে অনেক রোগী সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডাঃ মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান সম্ভব নয়। ইতোমধ্যেই চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ৮ থেকে ১০ জন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে।